Originally posted in বণিকবার্তা on 8 September 2025
তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে পারেনি বিবিএস
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুসারে গত আগস্টে মোটা চালের দাম ছিল ৫৫-৬০ টাকার মধ্যে। এ সময়ে সরু চালের দাম দাঁড়িয়েছে ৭৫-৮৫ টাকায়।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুসারে গত আগস্টে মোটা চালের দাম ছিল ৫৫-৬০ টাকার মধ্যে। এ সময়ে সরু চালের দাম দাঁড়িয়েছে ৭৫-৮৫ টাকায়। সব ধরনের চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও গতকাল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, আগস্টে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমেছে। শুধু মূল্যস্ফীতি নয়, বিবিএস কর্তৃক প্রকাশিত মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), মাথাপিছু আয়, দারিদ্র্যের হার, বৈদেশিক বাণিজ্য, শিল্প, শ্রমিক ও শিক্ষা পরিসংখ্যান-সংক্রান্ত তথ্য নিয়েও গবেষক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার ঘাটতি রয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে অতিরঞ্জিত পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছিল। অনেক অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লষক বলছেন, অতীতের কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে এখন পর্যন্ত নিজেদের প্রকাশিত তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে পারেনি বিবিএস।
দেশের জনমিতি, স্বাস্থ্য, শিল্প ও শ্রম, জাতীয় হিসাব, মূল্য ও মজুরি, শিল্প উৎপাদন ও মূল্যসূচক, দারিদ্র্য, পরিবেশগত, জেন্ডার ও কৃষিবিষয়ক পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও তথ্য পর্যালোচনা করা বিবিএসের মূল কাজ। সংস্থাটির এসব তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করে সরকার ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতিকৌশল নির্ধারিত হয়। ফলে এসব তথ্য-উপাত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ও আস্থার সংকট থাকলে এগুলোর ওপর ভিত্তি করে নেয়া নীতিকৌশলও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ত্রুটিপূর্ণ পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নেয়া নীতিকৌশলের কার্যকারিতার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ম্যানিপুলেটেড পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। এজন্য বছরের পর বছর ধরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), মাথাপিছু আয় ও রফতানির তথ্যে কারসাজি করা হয়। বিশেষ করে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরও দেশে আশানুরূপ কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় অর্থনীতির মূল সূচকগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ২০১৪ সালে পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেয়ার পর পরিসংখ্যান বিভ্রাট আরো প্রকট হয়। মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত তৈরির প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ে পাঁচ-ছয়জনের একটি সিন্ডিকেট। অভিযোগ ওঠে অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকের তথ্য অতিরঞ্জনের। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গেও বাড়তে থাকে পরিসংখ্যানগত পার্থক্য। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০১৫-১৯ সালের মধ্যে সাড়ে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানো হয়েছিল। এসব বানোয়াট পরিসংখ্যানের প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয় লোটাস কামাল তথা তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী মুস্তফা কামালকে।
গত আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের অতিরঞ্জিত অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান সংশোধন করা হবে বলে প্রত্যাশা ছিল সবার। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সে রকম কিছু হয়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মূলত পরিসংখ্যান তৈরির আগের কাঠামো বহাল থাকার পাশাপাশি অতীতের অতিরঞ্জিত সব পরিসংখ্যান সংশোধনে সার্বিক উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। এ দুটো কারণেই সরকার এখনো আগের অতিরঞ্জিত অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান থেকে বের হতে পারছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিবিএসের তথ্য নিয়ে জনগণের মধ্যে যে বিভ্রান্তি ছিল সেটি দূর করতে না পারা অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অনেক আগে থেকে বিভিন্ন কারণে বিবিএসের তথ্যের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। তথ্যের ক্ষেত্রে একবার আস্থা নষ্ট হলে তা ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন। বিবিএসের তথ্যের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট নতুন নয়। সেটা অন্তর্বর্তী সরকারও জানত। এ সরকারের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব ছিল অর্থনীতির ক্ষেত্রে তথ্যগত বিভ্রান্তি দূর করা। অর্থনৈতিক টাস্কফোর্স তাদের মতামতে বারবার বলে এসেছে বিবিএসের তথ্য ভুল-বিভ্রান্তিতে ভরা। সরকার যেভাবে চায় সেভাবে বিবিএস তথ্য দেয়। সে বিভ্রান্তি দূর করতে বিগত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে? এখন পর্যন্ত তথ্য নিয়ে সে বিভ্রান্তি, অবিশ্বাস রয়ে গেল। এই এক বছরে তথ্যের বিভ্রান্তি দূর করতে না পারা সরকারের চরম ব্যর্থতা বলে আমি মনে করি।’
তিনি আরো বলেন, ‘জনগণের মধ্যে বিবিএসের তথ্যের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে স্বচ্ছতা আনতে হবে। বিবিএস আজকে (গতকাল) মূল্যস্ফীতি কমার তথ্য দিল। কিন্তু জনগণ তো সেটা মনে করছে না। তারা দেখছে যে বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সেখানে বিবিএসের এ মূল্যস্ফীতি কমার তথ্যে মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত। মানুষ মনে করছে, বিবিএস যে তথ্য দিচ্ছে বাজারে সেটার কোনো প্রতিফলন নেই। কাজেই বেশির ভাগ মানুষ মূল্যস্ফীতি কমেছে, এ তথ্য বিশ্বাস করার মতো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। তারা মনে করছে, এখন যে তথ্য বিবিএস দিল সেটা সেই আগের রেজিমের মতো সরকারের ইচ্ছামাফিক তথ্য। মূল্যস্ফীতির যে তথ্য তারা দিচ্ছে সেটা কি আদৌ সঠিক বা তাদের জরিপ পরিচালনার পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা সেটা জনগণ জানে না। মানুষের মধ্যে একটি বিশ্বাস রয়ে গেছে, সরকার যেভাবে চায় বিবিএস সেভাবে তথ্য দেয়। কাজেই বিবিএসকে আস্থা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। জনগণ বাজারে যে তথ্য-উপাত্ত দেখছে সেটার প্রতিফলন যেন বিবিএসের তথ্যে থাকে তার জন্য ন্যূনতম সংস্কার করতে হবে। সেটা না করলে আস্থাটা ফিরে আসবে না। আস্থা ফিরিয়ে না আনতে পারলে সেটার দায়ভার বিবিএসকে নিতে হবে। যে তথ্য বাস্তব অবস্থা বা চিত্র তুলে ধরে না, সে তথ্যের ভিত্তিতে সরকার বা সংশ্লিষ্টরা রাষ্ট্র পরিচালনায় যে পদক্ষেপ নেবে সেটা ভুল পদক্ষেপ হবে। একটা সরকারি পরিসংখ্যান যদি বাস্তবতার প্রতিফলন বা তথ্যের বিভ্রান্তি দূর করতে না পারে তাহলে সে তথ্যের ভিত্তিতে একটি সরকার বা দেশের নীতিকাঠামো তো চলতে পারে না। কাজেই অবশ্যই বিবিএসের পদ্ধতিগত সংস্কার আনা উচিত।’
বিবিএসের পরিসংখ্যানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। চালসহ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিকভাবে বাড়ার কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যস্ফীতি হিটম্যাপ অনুযায়ী, খাদ্য মূল্যস্ফীতি হিসাবের ক্ষেত্রে চালের ভর ধরা হয় ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ গত বছরের আগস্টের তুলনায় এ বছরে আগস্টে মোটা ও সরু চালের দাম বেশি থাকলেও বিবিএসের হিসাবে এ সময়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতির বাস্কেটে ৭৪৯টি পণ্য যুক্ত করা হয়েছে। এখানে আলমারি, ল্যাপটপ, চেয়ার-টেবিল থেকে এমন অনেক পণ্য রয়েছে যা হয়তো কেউ জীবনে একবার ক্রয় করেন। আগে ৪২০টি পণ্য ছিল। কিন্তু এখন অনেক পণ্য থাকায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও তা মূল্যস্ফীতিতে তেমন প্রভাব ফেলে না। যদি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের হিসাবে মূল্যস্ফীতি প্রকাশ করা হয়, তাহলে এটা বর্তমান হারের কয়েক গুণ হয়ে যাবে।
অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশকের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা থাকে জিডিপির। বৈশ্বিকভাবে জিডিপির অনুপাতের সঙ্গে ঋণ কিংবা রফতানি থেকে শুরু করে রাজস্ব আয়সহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক নির্দেশকের তুলনা করা হয়। গত দেড় দশকে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারেননি দেশী-বিদেশী অর্থনীতিবিদ ও পর্যবেক্ষকরা। একটি দেশের ঋণের নিরাপদ সীমা কত হবে, রফতানি আয় পর্যাপ্ত কিনা, ব্যয় মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব আহরণ হচ্ছে কিনা—এসব কিছু পরিমাপ করা হয় জিডিপির অনুপাতে। ফলে জিডিপির তথ্য অতিরঞ্জিত হলে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এসব নির্দেশকও ভুল তথ্য দেবে। বিগত সরকার ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখাতে জিডিপি বাড়িয়ে দেখিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চূড়ান্ত হিসাবে দেশের জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ৪৫০ বিলিয়ন ডলারে। আর সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সাময়িক হিসাবে জিডিপির আকার ৪৬২ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রায় পুরোটা সময় অস্থিরতার মধ্য দিয়ে পার করেছে দেশের অর্থনীতি। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের মন্দার পাশাপাশি কর্মসংস্থান পরিস্থিতিও আশাব্যঞ্জক ছিল না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির এ তথ্য অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। তাছাড়া অতীতে জিডিপির তথ্যে যেসব অতিরঞ্জন করা হয়েছিল সেগুলো সংশোধন করার কোনো উদ্যোগও দেখা যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গলদ রয়েছে বিবিএসের জিডিপির হিসাব পদ্ধতির মধ্যেই। অনুমাননির্ভর এবং অনেক পুরনো তথ্যের ভিত্তিতে এ হিসাব করে সংস্থাটি। ফলে অনেক সময় বাস্তবতার সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এবারো পদ্ধতিগত কোনো পরিবর্তন না করার কারণেই জিডিপির হিসাবে তেমন কোনো পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন তারা। তাই বিবিএসের সামগ্রিক পরিবর্তনে দ্রুত উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ বিশ্লেষকদের।
বিবিএসের তথ্যে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সংস্থাটির আমূল সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করেন বিবিএস শক্তিশালী করতে সরকার গঠিত বিশেষজ্ঞ টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সামগ্রিক দিক চিন্তা করলে বলতে হয় বিবিএসকে শক্তিশালী করার প্রয়োজন আছে। জনগণ বা রাষ্ট্রের স্টেকহোল্ডারদের কাছে গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য তথ্য তুলে ধরতে হলে বিবিএসকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। জরিপে তারা যে তথ্য পাবে সেটি প্রকাশে যেন কোনো বাধা তারা না পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বিবিএসের তথ্যের স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা নিয়ে অনেক আগে থেকে আমরা কথা বলছি। তারা যে তথ্য পাবে সেটা সঠিক, সময়মতো এবং সবার জন্য উন্মুক্ত করে প্রকাশ করার স্বাধীনতা তাদের থাকতে হবে। এজন্য বিবিএসের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এটা ঠিক যে গত এক বছরে সরকারি তথ্যের ওপর আস্থা ফিরে আসেনি। এর অন্যতম কারণ সংস্কার না হওয়া। বিবিএসের অনেক সংস্কার করতে হবে। সংস্কারের সুপারিশ করতে পারে টাস্কফোর্স। কিন্তু সে নীতিগুলো কাগজে বন্দি করে রাখলে কিন্তু পরিবর্তন আসবে না। নীতিগুলো যাচাই-বাছাই করে কোথায় কী পরিবর্তন, পরিমার্জন করতে হবে সেটি দেখতে হবে। আবার সংস্কার একদিনে করে ফেলার বিষয় নয়। এটি অভ্যাসে পরিণত করতে হবে, চলমান রাখতে হবে। সংস্কারটা যথাযথভাবে শুরু করতে হবে এবং পরবর্তী যারা ক্ষমতায় আসবে তাদের সংস্কার চালিয়ে নিতে হবে। তার পরই আমরা একটি শক্তিশালী বিবিএস পাব। বিবিএসের তথ্যের ওপর যেন মানুষের ভরসা থাকে, তারা যেন স্বাধীনভাবে তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ করতে পারে এবং সে ধরনের সংস্কার নেয়ার সুপারিশ টাস্কফোর্স থেকে করব এবং সেটি পরবর্তী সরকারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’
স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ ও উন্নয়নকে অতিরঞ্জিত করে দেখাতে গিয়ে বিগত সরকার জিডিপির পাশাপাশি মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যানকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে। এ নিয়েও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। বিবিএসের হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৭৪৯ ডলার। এর পরের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এটি কিছুটা কমে ২ হাজার ৭৩৮ ডলারে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ৮২০ ডলারে দাঁড়িয়েছে।
টাস্কফোর্সের আরেক সদস্য ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মোহাম্মদ ইউনুস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিবিএসের কিছু দুর্বলতা আছে। তারা তাদের পদ্ধতিতে গবেষণা করে। সেটা নিয়ে অনেকে না বুঝে সমালোচনাও করে। তবে সেগুলো সংস্কারে টাস্কফোর্স করা হয়েছে। টাস্কফোর্স একটি রিপোর্ট দেবে। সেটার ওপর সরকার আইন করবে। তার পরে কিছু পরিবর্তন হবে বলে আশা করি।’
খোদ বিবিএস পরিচালিত এক জরিপে সংস্থাটির তথ্যকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি ব্যবহারকারী—এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি পরিসংখ্যান নিয়ে তাদের অবিশ্বাস সবচেয়ে বেশি। সংশয় রয়েছে বিবিএসের অন্য সব তথ্য নিয়েও। বিআইডিএসের সঙ্গে যৌথভাবে বিবিএসের এ জরিপ পরিচালিত হয়। শিক্ষাবিদ, গবেষক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও উন্নয়ন অংশীদার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এ জরিপে অংশ নেন। ‘ব্যবহারকারী সন্তুষ্টি জরিপ-২০২৪’ শীর্ষক এ জরিপে উঠে আসে মোট ব্যবহারকারীর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা ৩৩ দশমিক ১৬ শতাংশ বিবিএসের মূল্যস্ফীতিসংক্রান্ত পরিসংখ্যানকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না। এর পরই ২৬ শতাংশ মানুষ ন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দিহান। এর মাধ্যমে জিডিপির হিসাব-নিকাশ করা হয়। আর ২৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ মানুষ আয় ও দারিদ্র্যের হিসাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে সন্দেহ রয়েছে ২৯ দশমিক ৯২ শতাংশ মানুষের। ২৩ শতাংশের বেশি মানুষ শিল্প, শ্রম ও শিক্ষাবিষয়ক পরিসংখ্যান নিয়ে দ্বিধায় থাকেন।
বিবিএসের সক্ষমতা ও স্বাধীনতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে স্বল্প পরিসরে কিছু কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে কোরিয়ার অর্থায়নে আধুনিক ডাটা ওয়্যারহাউজ স্থাপন করতে যাচ্ছে বিবিএস। এটি স্থাপন হলে পরিসংখ্যান পরিষেবার সক্ষমতা বাড়বে। বিবিএসের ডাটায় সবাই প্রবেশাধিকার পাবে। জিডিপি হিসাব প্রাক্কলন, মূল্যস্ফীতির তথ্য-উপাত্ত কিংবা নিজস্ব জরিপ প্রতিবেদন এখন থেকে যাতে বিবিএস স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারে সেজন্য এ বছরের মে মাসে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এর ফলে যেকোনো তথ্য প্রকাশে এখন থেকে মন্ত্রী, উপদেষ্টা কিংবা সরকারের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমতি এবং স্বাক্ষর নেয়ার কোনো প্রয়োজন পড়বে না বিবিএসের।
বিবিএসের তথ্য-উপাত্তের বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতির বিষয়ে সংস্থাটির মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান এসব সমালোচনা সঠিক নয় বলে দাবি করেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের তথ্য নিয়ে প্রতিবার বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা হয়। অনেকে বলেন, আমরা ম্যানিপুলেটেড তথ্য প্রকাশ করছি। আমরা নিজস্ব পদ্ধতি ব্যবহার করে জরিপ করে সেটি প্রকাশ করি। এখানে প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা যে পদ্ধতিতে কাজ করি সে পদ্ধতি তুলে ধরতে অনেক ওয়ার্কশপ করেছি। প্রক্রিয়াটা তুলে ধরতে কাজ করেছি। বাইরে থেকে অনেকে অনেক কথা বলেন। যতটুকু বলা হয় সে রকম সমস্যা কিন্তু আমাদের মধ্যে নেই। যদি সমস্যা থেকেও থাকে তা সমাধানে বিবিএস শক্তিশালী করতে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে টাস্কফোর্স করা হয়েছে। তারা প্রতিবেদনে কোনো সমস্যার কথা বললে সেটি সমাধানে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। দুই-একদিনের মধ্যে টাস্কফোর্স তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে। সেগুলোর জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। সে আলোকে সংস্কারের পরিকল্পনা আমাদের আছে। তথ্যের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে আমরা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি।’