আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও ভোক্তারা সুফল পাচ্ছেন না – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in বাংলা ট্রিবিউন on 5 October 2025

বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে, বাংলাদেশে বাড়ছে কেন

বাংলাদেশের বাজারে চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে মাছ-মাংস ও সবজির দাম উল্টো ঊর্ধ্বমুখী

বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দামে সাম্প্রতিক সময়ে স্বস্তির ইঙ্গিত মিললেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব পড়েনি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরে বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যসূচক সামান্য হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১২৮ দশমিক ৮ পয়েন্টে, যা আগের মাসের ১২৯ দশমিক ৭ পয়েন্টের তুলনায় কম। বিশ্ববাজারে বিশেষ করে চিনি ও দুগ্ধজাত পণ্যের দাম নেমেছে, কমেছে গম-চালের মূল্যও। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে মাছ-মাংস ও সবজির দাম উল্টো ঊর্ধ্বমুখী। এতে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়েছে বহুগুণ।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও দেশীয় বাজারে তার প্রভাব দৃশ্যমান নয়। কারণ, দেশের উৎপাদন ব্যয়, জ্বালানি খরচ ও পরিবহন ব্যয় তুলনামূলকভাবে এখনও অনেক বেশি। ফলে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে হলে অভ্যন্তরীণ ব্যয় কাঠামো পুনর্বিবেচনা জরুরি হয়ে পড়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশের বাজারে তার খুব বেশি প্রভাব পড়ছে না। কারণ, আমদানিকৃত পণ্য যখন বাজারে আসে, তখন মধ্যসত্ত্বভোগীরা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ যতটা জরুরি, তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনায় কার্যকর হস্তক্ষেপ।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য কমায় দেশে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ কিছুটা কমার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে এই সুফল ভোক্তারা পেতে হলে দরকার সরকারি মনিটরিং জোরদার করা, বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা ।’

তিনি উল্লেখ করেন, ‘নীতিনির্ধারকরা যদি এসব নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে শিগগিরই ভোক্তারা বাজারে স্বস্তির প্রতিফলন দেখতে পাবেন।’

অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের শিল্প ও পরিবহন খাতে উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ডিজেলের উচ্চমূল্য। তারা মনে করেন, এসব খাতে ব্যয় হ্রাস করা গেলে সরবরাহ ও বাজার ব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিযোগিতা, তদারকি ও নীতিগত স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশীয় বাজারে ভোক্তারা তেমন কোনও স্বস্তি পাবেন না।

বিশ্ববাজারে স্বস্তি, দেশে অস্থিরতা

বিশ্ববাজারে সরবরাহ বেড়ে খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে এর বিপরীত চিত্র। এর পেছনে মৌসুমি প্রভাব, আমদানি নির্ভরতা, সীমান্ত বাণিজ্য ব্যাহত হওয়া এবং বাজারে অস্বচ্ছ প্রতিযোগিতাকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের বাজারে দাম কমানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর বাজার তদারকি, পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে পড়েছে। অন্যথায় বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের ভোক্তারা এর সুফল থেকে বঞ্চিত হবেন।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: চিনি ও দুগ্ধের দাম কমলেও মাংসে উল্টো চাহিদা

এফএওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে চিনির দাম সেপ্টেম্বরে ৪ দশমিক ১ শতাংশ কমেছে, যা ২০২১ সালের পর সর্বনিম্ন। মূলত ব্রাজিলে উৎপাদন বেশি হওয়া এবং ভারত-থাইল্যান্ডে ভালো ফলনের সম্ভাবনা দাম কমার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। একই সময়ে দুগ্ধজাত পণ্যের দাম ২ দশমিক ৬ শতাংশ কমে গেছে, বিশেষত মাখনের দরপতন এর মূল কারণ।

এছাড়া গম, ভুট্টা ও চালের দামও কমেছে চাহিদা হ্রাস এবং সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে। তবে গরু ও ভেড়ার মাংসের দাম বেড়েছে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে চাহিদা বাড়লেও সরবরাহ সীমিত থাকায় বাজারে চাপ তৈরি হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক শস্য উৎপাদন ২ দশমিক ৯৭১ বিলিয়ন মেট্রিক টনে পৌঁছাতে পারে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি—এটি হবে ২০১৩ সালের পর সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি।

বাংলাদেশ: মূল্যস্ফীতিতে সাময়িক স্বস্তি, কিন্তু বাজার অস্থির

বাংলাদেশে আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৮.২৯ শতাংশে, যা ৩৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি তখনও ঊর্ধ্বমুখী ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আশা করেছিলেন, সেপ্টেম্বরে তা ৭ শতাংশের নিচে নামতে পারে। কিন্তু বাজারের বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা—খাদ্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে, বিশেষত উৎসব ও মৌসুমি কারণের অজুহাতে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)র তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় এ বছর চাল, ডাল, আটা-ময়দা, তেল, মাছ ও মাংসের দাম বেড়েছে। কিছুটা স্বস্তি মিলেছে পেঁয়াজ, রসুন ও ডিমে।

চাল, ডাল, তেল—সবখানেই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা

বাজারে চিকন চাল এখন ৭৫–৮৫ টাকা কেজি, যা গত বছর ছিল ৬৪–৮০ টাকা।

ছোট দানার মশুর ডালের কেজি ১৫০–১৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ১২৫–১৩৫ টাকা।

খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭০–১৭৮ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন ১৮৮–১৯০ টাকা, আর ৫ লিটার বোতলের দাম ৯০০ টাকার ওপরে।

মাছ-মাংসে অস্বস্তি

মৌসুমে ইলিশও সাধারণের নাগালের বাইরে। ছোট আকারের ইলিশ কেজি ৫০০–৭০০ টাকায়, আর বড় ইলিশ ১,০০০ থেকে ২,৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

রুই-কাতলা কেজি ৩০০–৫০০ টাকা, খাসির মাংস ১,০০০–১,২০০ টাকা, গরুর মাংস ৭৫০ টাকা।

সবজির বাজারে অস্থিরতা, মরিচ-সবজি হাতের নাগালের বাইরে

রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শাক-সবজি ও মসলার দাম ক্রমাগত বাড়ছে।

কাঁচা মরিচ কেজিতে ৩০০–৩৫০ টাকা, যা সপ্তাহখানেক আগে ছিল ১৮০–২৫০ টাকার মধ্যে।

গোল বেগুন কেজি ২২০ টাকা, গাজর ১২০ টাকা, টমেটো ১৪০ টাকা, বরবটি ১০০ টাকা।

শিম এক সপ্তাহে ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২৪০ টাকা কেজিতে উঠেছিল, পরে কমে এসেছে ১৬০ টাকায়।

বিক্রেতাদের দাবি, পূজার কারণে সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে পণ্য আসা বন্ধ, সঙ্গে টানা বৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতি হওয়ায় সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে সাধারণ ক্রেতারা মনে করেন, বাজারে কোনও কার্যকর তদারকি নেই, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে বেশ কিছু খাদ্যপণ্যের দাম নিম্নমুখী হলেও তার প্রভাব দেশীয় বাজারে পড়ছে না, যার মূল কারণ সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণে উদাসীনতা।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কমলেও ব্যবসায়ীরা দেশীয় বাজারে সেই অনুযায়ী দাম সমন্বয় করছেন না। বরং তারা কেবল দাম বাড়ানোর দিকেই আগ্রহী। ট্যারিফ কমিশনও দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে যতটা সক্রিয়, দাম কমানোর ক্ষেত্রে ততটাই নিষ্ক্রিয়। ব্যবসায়ীরাই যেহেতু বাজার সমন্বয়ের কাজটি করে থাকেন, তাই তারা না চাইলে ট্যারিফ কমিশন বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোনও উদ্যোগ নেয় না।’

নাজের হোসাইন আরও বলেন, ‘উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—বিশ্ববাজারে গম, আটা ও ময়দার দাম অনেকদিন ধরেই কম, কিন্তু দেশে তার কোনও প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। আবার সয়াবিন তেলের দাম সামান্য বাড়লেই ব্যবসায়ীরা নিজেরা সরবরাহ সীমিত করে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন। এমনকি সরকারকে তেলের দাম বাড়ানোর অনুমোদন দিতেও চাপ দেন।’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘দাম বাড়লেই সরকারের পক্ষ থেকে আমদানি শুল্ক ও কর কমানোর মতো নানা নীতি-সহায়তা দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সুফল ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছায় না—ব্যবসায়ীরাই সেটি আত্মসাৎ করে।’