Originally posted in সমকাল on 9 December 2025
কাঙ্ক্ষিত সংস্কার না হলে ঋণনির্ভরতা বাড়বে
বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুমাত্রিক ও কাঠামোগত সংকটের মুখে। কাঙ্ক্ষিত সংস্কার না হলে বা বিলম্বিত হলে দেশের ঋণনির্ভরতা আরও বাড়বে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে এবং বৈষম্য বাড়বে। এমন সতর্কবার্তা দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও গবেষকরা।
গতকাল রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে ইউনিসেফের সহযোগিতায় সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) আয়োজিত এক সেমিনারে এমন মত এসেছে। সেমিনারের বিষয় ছিল, বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি): অগ্রগতি প্রতিবেদন ২০২৫। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার অর্থবিষয়ক বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, যেকোনো দেশে বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে মূল্যস্ফীতি বাড়ে এবং প্রবৃদ্ধি কমে। তবে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে তা হয়নি। বরং মূল্যস্ফীতি কমেছে, প্রবৃদ্ধি মোটামুটি আছে। সরকারের নানা সংস্কার পদক্ষেপের ফলে যা সম্ভব হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, অনেকে বন্দর কেন বিদেশিদের ব্যবস্থাপনায় দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে বিতর্ক করছেন। আসলে বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে না পারলে উৎপাদন ব্যয় কমানো যাবে না।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, দেশ ইতোমধ্যে ঋণের ফাঁদে পড়েছে। এ সত্য স্বীকার না করলে সামনে এগোনো যাবে না। কর-জিডিপি অনুপাত কয়েক বছর আগেও ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। এখন তা ৭ শতাংশের ঘরে। জিডিপির বড় অংশ থেকে কর সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ মাহবুব উল্লাহ বলেন, লুটপাটভিত্তিক অর্থনীতি ভেঙে ক্ষমতার ভারসাম্য না আনলে কোনো উন্নয়ন টেকসই হবে না। দেশ স্বাধীনের পর এ পর্যন্ত পর্যন্ত যেভাবে সম্পদ এক হাত থেকে আরেক হাতে স্থানান্তরিত হয়েছে, তাতে উৎপাদনভিত্তিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যতদিন সম্পদ পুনর্বণ্টনের চক্র শেষ না হবে, টেকসই উন্নয়ন অধরাই থাকবে।
তিনি বলেন, নানান নীতি, পরিকল্পনা ও সংস্কার পদক্ষেপ নেওয়া হলেও কোনোটিই টেকসই হয়নি। কারণ ক্ষমতার অসম বণ্টন, আর্থিক সুযোগের দখল ও সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোর কেন্দ্রীভবন অর্থনীতিকে আরও ভঙ্গুর করেছে। বিনিয়োগ পরিবেশ মন্থর ও উদ্দীপনাহীন। তৈরি পোশাক ও রেমিট্যান্স ছাড়া অন্য কোনো সম্ভাবনাময় খাত এখনও জাতীয় পর্যায়ে উঠতে পারেনি।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অর্থনীতি কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে–এটি যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি হলো–এটি আরও খারাপ হতে পারত। অর্থনীতির সামনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের সংকেত আছে। তবে নেতিবাচক দিকটি বেশি ভারী।
তিনি উল্লেখ করেন, রেমিট্যান্সপ্রবাহ নতুন উচ্চতায়, যা বৈদেশিক মুদ্রাবাজারকে সাময়িক স্বস্তি দিয়েছে। তবে অবৈধ আর্থিকপ্রবাহ রোধ, আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং বাজেট ঘাটতি অর্থনীতিতে চাপ বাড়ার দিকে ইঙ্গিত করছে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ধীর, বিশেষত ইউরোপনির্ভর বাজারে প্রতিযোগিতা কমছে। জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে নীতিগত সংস্কার কতটুকু ধারাবাহিকভাবে এগোবে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া কতটা বাধাহীনভাবে সম্পন্ন হবে–তার ওপর।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে দেশ ঋণের ফাঁদে পড়বে। বাংলাদেশ এখন রাজস্ব সংকট, ঋণ পরিশোধের চাপ ও নীতিগত দুর্বলতায় এক ঝুঁকিপূর্ণ পথে হাঁটছে। দেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে, যা ২০১৫ সালে ছিল ১০ দশমিক ৯ শতাংশ।
তিনি বলেন, কর ব্যবস্থায় ভয়াবহ অদক্ষতা রয়েছে। চার লাখ পয়েন্টে ভোক্তারা ভ্যাট দেন, কিন্তু সরকারি কোষাগারে ভ্যাট আসে মাত্র ২৪ হাজার পয়েন্ট থেকে। এটি সরাসরি দুর্নীতির প্রমাণ। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের তথ্য একীভূত না করলে কর ফাঁকি বন্ধ হবে না। তিনি সতর্ক করে বলেন, সুদ পরিশোধ ইতোমধ্যে রাজস্ব বাজেটে কৃষি ও শিক্ষাকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যয়। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ ঋণের ফাঁদে পড়তে পারে।
তিনি বলেন, অর্থনীতিকে দুটি মানদণ্ড দিয়ে বিশ্লেষণ করি– একদিকে জুলাই-আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময়কার অবস্থা, অন্যদিকে ছাত্র নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের লক্ষ্য ও প্রত্যাশা– তাহলে দেখতে পাই যে, স্থিতিশীলতা এলেও এর জন্য মূল্যও দিতে হয়েছে। ব্যাংকিং খাতেও এর প্রতিফলন আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সংস্কারমূলক উদ্যোগ নিলেও উচ্চ নীতি সুদহার ও বাজার সুদহার ব্যবসার খরচ বাড়িয়েছে। দুর্নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দূর না করলে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় কমবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক খাত সংস্কারে ইতিবাচক অগ্রগতি আছে। সমস্যাগ্রস্ত পাঁচ ব্যাংকের মার্জার প্রক্রিয়া দ্রুত এগোচ্ছে, ডিপোজিট গ্যারান্টি ১ লাখ থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা হয়েছে। আগামী এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়া শুরু হতে পারে। গভর্নর বলেন, প্রায় ৭৬ লাখ আমানতকারী আমানত ফেরত পাবেন। নতুন একীভূত ব্যাংকটি প্রথম বা দ্বিতীয় বছরেই মুনাফার মুখ দেখতে পারে বলে আশা করেন তিনি।
সেমিনারে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও এসডিজি অর্জন বিষয়ে জিইডি উপস্থাপিত প্রবন্ধে বলা হয়–উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রা সংকট, বাণিজ্য ঘাটতি ও ব্যয় চাপে সামষ্টিক অর্থনীতি চাপে আছে। খেলাপি ঋণ, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা ও সুশাসন সংকটে বিনিয়োগ পরিবেশ স্থবির হয়ে আছে। এ ছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দক্ষতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে এসডিজির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা সময়সীমার তুলনায় পিছিয়ে আছে দেশ।



