Professor Mustafizur Rahman on RMG working condition

Published in Banik Barta on Saturday, 22 March 2014.

শিল্প খাতে কর্মপরিবেশ নিম্নস্তরে বাংলাদেশ

বদরুল আলম

untitled_35496

শিল্প-কারখানায় কর্মপরিবেশের বিচারে নিম্নস্তরের দেশগুলোর মধ্যে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। এ অবস্থানের পেছনে ভূমিকা রেখেছে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন ও রানা প্লাজা ধসের মতো বড় দুটি শিল্প দুর্ঘটনা। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের অপ্রতুল মজুরি ও স্বাস্থ্যসেবাও এক্ষেত্রে অবদান রেখেছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাপলক্রফট লিমিটেডের তৈরি তালিকায় বাংলাদেশের এ অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির তৈরি চরম ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। গোলযোগপূর্ণ সোমালিয়া, জিম্বাবুয়ে, এমনকি আফগানিস্তানও এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মপরিবেশের নিরাপত্তায় নিম্নস্তরে অবস্থানের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন ও রানা প্লাজা দুর্ঘটনা পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করেছে। যদিও এ দুর্ঘটনার পর কারখানায় কর্মপরিবেশের উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো দৃশ্যমান করতে সরকার ও উদ্যোক্তা উভয়ের উদ্যোগেই ঘাটতি রয়েছে। এসব কারণেই কর্মপরিবেশের এ নাজুক চিত্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উঠে আসছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার আগ থেকেই দেশের শিল্প খাত এক ধরনের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। দুর্ঘটনার পর মজুরি বৃদ্ধিসহ কর্মপরিবেশের উন্নয়নে অগ্রগতিও হয়েছে। এটা আমলে নিলে অবস্থান এত খারাপ হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে তালিকার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের নাম মেনে নেয়া কঠিন।

আন্তর্জাতিক এ সূচক পোশাক ক্রেতাদের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও পর্যবেক্ষণে রাখেন মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, পোশাকসহ দেশের সব শিল্পোদ্যোক্তাকে এ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কর্মপরিবেশে দৃশ্যমান অগ্রগতি আনতে হবে।

১৯৭টি দেশের ওপর তৈরি ম্যাপলক্রফটের ওয়ার্কিং কন্ডিশন ইনডেক্স (ডব্লিউসিআই)-২০১৪ প্রকাশ করা হয়েছে চলতি বছরের প্রথম দিকে। সূচক তৈরিতে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ন্যূনতম মজুরি ও কর্মঘণ্টা। এর ভিত্তিতে ৬০টি দেশকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বিবেচিত হয়েছে আফ্রিকার ইরিত্রিয়া। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া ও কঙ্গো প্রজাতন্ত্র। এর ঠিক পরই অর্থাৎ পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পরের পাঁচটি দেশ যথাক্রমে সোমালিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, দক্ষিণ সুদান ও জিম্বাবুয়ে।

প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদন অনুসারে, বড় কোনো দুর্ঘটনা মোকাবেলার সামর্থ্য দেশের শিল্প খাতের নেই। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে বিদ্যমান আইন প্রয়োগেও শৈথিল্য রয়েছে। পাশাপাশি উচ্চমাত্রায় দুর্নীতিপ্রবণতাসহ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সম্পদের স্বল্পতাও রয়েছে।

গত বছরের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করে ম্যাপলক্রফট বলেছে, বাংলাদেশের শিল্প-কারখানায় অগ্নিকাণ্ডসহ নিয়মিত দুর্ঘটনা ২০১৩ সালজুড়েই ঘটেছে; চলতি বছরের সূচকে যা প্রভাব ফেলেছে।

শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন ও রানা প্লাজা ধসের মতো পর পর দুটি দুর্ঘটনাই চরম ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে ওপরের দিকে নিয়ে এসেছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নেতিবাচক প্রচারণাও এজন্য দায়ী।

তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজীম বলেন, নিজ তাগিদেই কর্মপরিবেশসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দ্রুত আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হবে। উদ্যোক্তা, সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে সরকারও সে লক্ষ্যে কাজ করছে।

বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা মানও অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছে ম্যাপলক্রফট। সমপর্যায়ের হলেও অনেক দেশের অবস্থান এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে বেশ ভালো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার              দেশগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার অবস্থান তালিকায় যথাক্রমে ২০, ২৪ ও ২৬তম। রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে চীন ও মিয়ানমারও অবস্থানে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। ২০০৯ সালের ষষ্ঠ থেকে চীনের অবস্থান এবার ৩৭তম। আর মিয়ানমারের অবস্থান চরম ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় ১৪তম। গত বছর এ সূচকে দেশটির অবস্থান ছিল প্রথম।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের ব্যর্থতায় বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের নেতিবাচক সমালোচনা হচ্ছে, যা এ ধরনের সূচকের অবস্থানকে আরো পাকাপোক্ত করছে। ধারাবাহিক উন্নয়ন ঘটিয়েই আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। যেকোনো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্যবেক্ষণগুলোর প্রতি সরকারি-বেসরকারি নজরদারিও বাড়ানো প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিবেদনে পূর্ণাঙ্গ তথ্য যাতে উঠে আসে, সেজন্যই এটা প্রয়োজন।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব এম হুমায়ুন কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দেশে সামগ্রিক সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে শুধু রানা প্লাজাকে কেন্দ্র করে সূচকে নেতিবাচক অবস্থান যথার্থ বলে মনে হয় না। আর অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রীয় তথ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণেই সূচকে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি আংশিকভাবে উঠে এসেছে।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে সপ্তমবারের মতো প্রকাশিত ম্যাপলক্রফটের এ সূচকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ ছাড়াও উচ্চ, মধ্যম ও নিম্নঝুঁকির দেশ চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১৩ সালে উচ্চঝুঁকিপূর্ণ ১১টি দেশ এ বছর চরম ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় চলে এসেছে। এ দেশগুলো যোগ হওয়ায় এবার চরম ঝুঁকিপূর্ণ দেশের সংখ্যা ৪৯ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০।