Published in Daily Naya Diganta on Monday, 26 May 2014.
অভিভাবক নেই নিয়ন্ত্রণকারীও নেই ফ্রিস্টাইলে চলছে পোশাক শিল্প খাত
জিয়াউল হক মিজান
রফতানি আয়ে ৮০ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতকে দেখাশোনার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। কখনো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কখনো বস্ত্র মন্ত্রণালয়, কখনো শিল্প মন্ত্রণালয় আবার কখনো শ্রমমন্ত্রণালয় ছড়ি ঘোরায় এ শিল্প খাতের ওপর। কর্তৃত্ব দেখাতে চায় পরিবেশ, স্থানীয় সরকার, গণপূর্ত, স্বরাষ্ট্র, অর্থ, পরিকল্পনা, পাটসহ অন্তত ১৭টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ। এ খাতের কোনো দুর্ঘটনা বা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার দায় নিতে রাজি হয় না কোনো কর্তৃপক্ষই। ফলে নিয়ন্ত্রক, অভিভাবক এবং পরিকল্পনার অভাবে অনেকটা ফ্রি স্টাইলেই চলছে এ শিল্প খাত। তৈরী পোশাক শিল্প খাতের জন্য অ্যাপারেল বোর্ড গঠনের আলোচনা শেষ হয়নি গত ২৫ বছরেও। ফলস্বরূপ বিভিন্ন সরকারি অফিসকে ম্যানেজ করতে প্রতি বছর অন্তত ৩৫০ কোটি টাকা গুনতে হয় এ খাতের উদ্যোক্তাদের।
গত তিন যুগের অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় তৈরী পোশাক শিল্প খাত এখন যেকোনো বিবেচনায় দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাত। শিল্প খাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অপরাপর বেসরকারি খাতের ধারাবাহিক অবনতি ঘটলেও অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলেছে এ খাতটি। ১৯৯১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে পোশাক শিল্প খাতের জন্য সর্বপ্রথম একটি পৃথক অ্যাপারেল বোর্ড গঠনের দাবি তোলেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। প্রতি বছরই তৈরী পোশাক রফতানিকারকদের বার্ষিক প্রধান উৎসব বাটেক্সপোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এবং সমাপনী অনুষ্ঠানে বিরোধীদলীয় নেতার কাছে এ দাবি উত্থাপন করে আসছেন তারা। অসংখ্যবার দাবি তোলা হয়েছে পৃথক একটি মন্ত্রণালয় খোলার জন্য। প্রতিবারই সব পক্ষ থেকে উদ্যোক্তারা কেবল আশ্বাসই পেয়ে আসছেন। আলোচনা চলমান আছে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
দুর্নীতিবিরোধী গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এ খাত থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে মোট দেশজ রফতানির ৭৯.৬৩ শতাংশ অর্জিত হয়, জিডিপিতে এ খাতের অবদান প্রায় ১০ শতাংশ যা সম্পূরক শিল্প মিলে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ। এ খাতে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশই নারী। তৈরি পোশাক শিল্পকে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থানকারী এবং দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড মন্তব্য করে টিআইবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তৈরী পোশাক খাতের এ অর্থনৈতিক সাফল্য এ খাতের সামগ্রিক চিত্র প্রকাশ করে না। সরকার কর্তৃক বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনা ও সুবিধা প্রদান করা হলেও এ খাতের মূল চালিকাশক্তি শ্রমিকের অধিকার ও নিরাপত্তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। কারখানার অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর কর্ম অবস্থা এবং সোস্যাল কমপ্লায়েন্সের ঘাটতি এ অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
নির্দিষ্ট কোনো মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে না থাকায় তৈরী পোশাক কারখানার উদ্যোক্তাদের সরকারের ১৭টি প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন ধরনের সনদ নিতে হয়। সনদ বা তালিকাভুক্তিতে এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারি ফির অতিরিক্ত টাকা প্রদান করতে হয়। সিপিডির ওই গবেষণা মতে একজন তৈরী পোশাক কারখানা মালিককে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে সার্বিকভাবে ৭ থেকে ২০ লাখ টাকা অতিরিক্ত প্রদান করতে হয়। দেশে মোট কারখানার সংখ্যা পাঁচ হাজার ধরলেও অতিরিক্ত এ অর্থের পরিমাণ বছরে ৩৫০ কোটি টাকা। ফাইল ঠেকিয়ে অর্থ আদায়কারী এসব সংস্থার মধ্যে রাজউক, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, পরিবেশ অধিদফতর, বিদ্যুৎ বিভাগ, ওয়াসা, গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানি, ফায়ার সার্ভিস, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী, কারখানা পরিদর্শন অধিদফতর প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর অভিযোগ, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতি সাম্প্রতিক বিভিন্ন দুর্ঘটনা, সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যু ও পঙ্গুত্ববরণ, শ্রমিক অসন্তোষ ও অস্থিরতা, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতকে বিভিন্ন নেতিবাচক পরিস্থিতি, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জিএসপি সুবিধা বাতিল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক জিএসপি বাতিলের হুমকি অথবা সাধারণ ক্রেতাদের বাংলাদেশী পণ্য বর্জনের আন্দোলন ইত্যাদির সম্মুখীন করছে।
বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, এ কথা সবাই স্বীকার করেন যে, জাতীয় অর্থনীতিতে আমরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছি। কিন্তু এত বড় সেক্টরে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রক নেই, অভিভাবকও নেই। দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে একটি কর্তৃপক্ষের দাবিতে আমরা বিভিন্ন সরকারের কাছে ধরনা দিয়ে আসছি। কিন্তু আশ্বাস ছাড়া কিছুই মেলেনি। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো যার হাতে যেটুকু কর্তৃত্ব আছে সেটুকু ছাড়তে চায় না বলে পোশাক শিল্পের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় হচ্ছে না। জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে সম্ভাবনাময় তৈরী পোশাক শিল্প খাতের জন্য একটি পৃথক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
লিড মিনিস্ট্রির অভাবে দেশের তৈরী পোশাক শিল্প খাত কাক্সিত গতি পাচ্ছে না মন্তব্য করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, তৈরী পোশাক শিল্প খাতের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষ গঠিত না হওয়ায় শিল্পের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারও। তবে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার লোকদের প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে মালিকপক্ষ কোনোমতে টিকে থাকলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট ৩৫ লাখ শ্রমিক। নির্দিষ্ট কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় যেকোনো দুর্ঘটনায় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। বারবার পদদলিত হচ্ছে শ্রম অধিকার।
পোশাক শিল্প খাতে চলমান সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের বিবেচনার জন্য সম্প্রতি বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছে টিআইবি; এর প্রথমটিই পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন সংক্রান্ত। এতে বলা হয়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, সমন্বয় ও তদারকি তৈরী পোশাক শিল্পের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে এবং মন্ত্রণালয়ের অধীনে কারখানা পরিদর্শন ও কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নের জন্য একটি অধিদফতর গঠন করতে হবে।