Published in Jugantor on Friday, 30 May 2014.
এগিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পিছিয়ে আওয়ামী লীগ
মামুন আব্দুল্লাহ
এক যুগে তিন সরকারের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহারে এগিয়ে রয়েছে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। পিছিয়ে রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। মধ্যবর্তী অবস্থানে রয়েছে বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিবছর গড়ে ৮৫ শতাংশ বৈদেশিক অর্থ ব্যবহার করেছে। বিএনপি সরকার করেছে ৮৪ দশমিক ৮ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকার ব্যবহার করেছে ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ। পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
সংশোধিত এডিপির বৈদেশিক অর্থ ব্যবহার না হওয়ার পেছনে ৮টি কারণ চিহ্নিত করেছে আইএমইডি। এর মধ্যে রয়েছে- দাতা সংস্থার প্রকিউরমেন্ট গাইডলাইন অনুসারে প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন ধাপে দাতাদের সম্মতি পেতে দেরি হওয়া, দাতা সংস্থার পরামর্শক পরিবর্তন করা, বৈদেশিক সহায়তার পাশাপাশি সরকারের নিজস্ব অর্থের যোগানে সমন্বয় না থাকা, দাতা সংস্থার কাছে সীমিত প্রবেশাধিকার, প্রকল্পে যথাসময়ে অর্থায়ন করতে না পারা, প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সরকারি কমকর্তাদের দক্ষতার অভাব এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে আইনগত জটিলতা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, দাতাদের অর্থ ব্যবহার করা অনেক জটিল। প্রকল্প বাস্তবায়নে নকশাগত কিছুটা পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হলে দাতারা তা বুঝতে চায় না। এ ছাড়া প্রকল্পের মাঝ পথে সংশোধনীর প্রয়োজন হলে তারা অর্থায়নসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে। ফলে বছরের পর বছর ধরে অর্থ থাকা সত্ত্বেও অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সংশোধিত এডিপিতে বৈদেশিক বরাদ্দের ৮০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারাটা সন্তোষজনক। তবে তা আরও বাড়ানো যেত যদি আমাদের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতো।
বিএনপির আমল : বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যবহারে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের আমল এগিয়ে। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ওই সরকারের ৫ বছরে বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহার হয়েছে গড়ে ৮৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে ২০০১-০২ অর্থবছরে সংশোধিত এডিপির বৈদেশিক অনুদান ছিল ছয় হাজার ১২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে পাঁচ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। ব্যবহৃত হয়েছে ৮১ শতাংশ। এর পরের অর্থবছর বৈদেশিক সহায়তার আকার ছিল সাত হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। সংশোধিত আকার হল ছয় হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮১ শতাংশ ব্যবহৃত হয়েছে।
২০০৩-০৪ অর্থবছরে বৈদেশিক খাতে আট হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয়। যার সংশোধনী আকার হল সাত হাজার কোটি টাকা। এর ৮০ শতাংশ ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যবহৃত অর্থের পরিমাণ পাঁচ হাজার ৬২২ কোটি টাকা।
২০০৪-০৫ অর্থবছরে সাত হাজার ৪২৫ কোটি টাকা বৈদেশিক সহায়তা ধরা হয়। পরে তা সংশোধন করে ছয় হাজার ২৫ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। বছর শেষে বাস্তবায়ন হয় ৯৩ শতাংশ। এ বছর মোট বরাদ্দ থেকে পাঁচ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়।
২০০৫-০৬ অর্থবছরে আট হাজার ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয়। এ থেকে অর্থ ছেঁটে ফেলে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয় আট হাজার ৫০ কোটি টাকা। বছর শেষে বাস্তবায়ন হয় ৮৯ শতাংশ। যার পরিমাণ ছয় হাজার ৩৪১ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এগুলো আগে দূর করে পরে অন্যের ওপর দোষ চাপানো উচিত। দাতাদের পক্ষ থেকে কিছু সমস্যা হয়তো থাকতে পারে তা ১০ ভাগের বেশি নয়। আর নিজেদের সমস্যা ৯০ ভাগ। তিনি বলেন, যেসব প্রকল্প দাতাদের সহায়তানির্ভর নয়, সেগুলোর অবস্থাও খারাপ। এক্ষেত্রে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের উদাহরণ টেনে বলেন, অবশ্যই প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক আমল : গত ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ক্ষমতায় ছিল ত্ত্বতাবধায়ক সরকার। তারা ২০০৬-০৭ অর্থবছরের অর্ধেক সময়, ২০০৭-০৮ অর্থবছরের পুরো সময় এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরের প্রথম অর্ধেক সময় ক্ষমতায় ছিল। দেখা যায়, যে সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল ওই সময়টিতেই বৈদেশিক সহায়তা ছাড় হয়েছে বেশি।
এর মধ্যে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ৯২ শতাংশ, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৭৮ শতাংশ এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৬৮ শতাংশ সহায়তা ব্যবহার হয়েছে। তাদের সময়ে গড়ে প্রতিবছর এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দ ছিল আট হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে ছিল আট হাজার ৫০০ কোটি টাকা। প্রকৃত ব্যয় হয়েছে আট হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। সংশোধিত বরাদ্দের চেয়ে তারা ৩৯ কোটি টাকা বেশি ব্যবহার করেছে। অন্য দুই সরকারই সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ বৈদেশিক সাহায্যের চেয়ে কম খরচ করেছে। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, ওই আমলের দুই বছরে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল না। দুর্নীতির প্রবণতাও কম ছিল। ফলে গড়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল বেশি। এ ছাড়া তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকায় তারা দাতাদের শর্তগুলো কোনো রকম জবাবদিহিতা ছাড়াই বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে দাতাদের কঠিন শর্তগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না বলে তারা বৈদেশিক সহায়তা খুব বেশি ব্যবহার করতে পারে না। যদিও রাজনৈতিক সরকারের আমলেই সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া যায়।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় অংশ থেকে আয়ের পরিমাণ বাড়িয়েছে। কিন্তু সে অর্থ উন্নয়নে ব্যয় করার মতো যথেষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। সরকারের আয় বাড়লেও পরিমাণ ও গুণগত ব্যয়ের সক্ষমতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এজন্য এডিপি বাস্তবায়নে গতি আসছে না। বারবার প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর হচ্ছে। এতে একদিকে সরকারের অর্থ অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে এর সুফল পেতে দেরি হচ্ছে। তিনি বলেন, জিডিপির প্রবৃদ্ধি অনুসারে সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে তবে জনসংখ্যার চাহিদার তুলনায় তা কম। এ ছাড়া বেসরকারি বিনিয়োগও যথেষ্ট নয়। এজন্য উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বৈদেশিক অর্থ ব্যবহার করতে না পারা দাতাদের চেয়ে আমাদের সমস্যাই বেশি।
আওয়ামী লীগ আমল : তত্ত্বাবধায়কের পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত এই ৫ বছরে গড়ে বৈদেশিক সহায়তা ব্যয় হয়েছে ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৯৬ শতাংশ ও সর্বনিু ৬৮ শতাংশ অর্থ ব্যয়ের নজির রয়েছে। বছরওয়ারি বিবেচনা করলে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মূল বরাদ্দ ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমিয়ে ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা করা হয়। এ বছর খরচ হয় সাত হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। যা সংশোধিত এডিপির ৬৮ শতাংশ।
পরের অর্থবছর ১২ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। পরে তা কমে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। বরাদ্দের ৮৪ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়। যা অর্থের পরিমাণে নয় হাজার ৫১২ কোটি টাকা।
২০১০-১১ অর্থবছরে এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তা ধরা হয় ১৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যা পরে কমিয়ে আনা হয় ১১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকায়। কিন্তু নয় হাজার ৮১০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। এতে বাস্তবায়নের হার দাঁড়ায় ৮২ শতাংশ।
২০১১-১২ অর্থবছরে ৮৫ শতাংশ বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহার করা হয়। এ বছর মূল বরাদ্দ ছিল ১৮ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। সংশোধন করে ধরা হয় ১৫ হাজার কোটি টাকা। ব্যবহার হয় ১২ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা।
এ ছাড়া গত বছরে এডিপিতে সহায়তা বাবদ ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা লক্ষমাত্রা ধরা হয়। কিন্তু পরে তা কমিয়ে বরাদ্দ ধরা হয় ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। রাজনৈতিকভাবে নির্বাচনী বছর বলে এ বছর ৯৬ শতাংশ অর্থ ব্যবহার করা সম্ভব হয়। এ হিসাবে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ১৬ হাজার ৫০২ কোটি টাকা।
চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরও একই ধারায় চলছে। এ বছর মোট বরাদ্দ ছিল ২৪ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। পরে সংশোধন করে ধরা হয় ২১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এপ্রিল পর্যন্ত ১২ হাজার ৮৪ কোটি টাকা ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে। যা বরাদ্দের ৫৭ শতাংশ।