Published in Jugantor on Sunday, 1 June 2014.
কালো টাকার সঞ্চালন স্তিমিত
মনির হোসেন ও শাহ আলম খান
দেশে কালো টাকার সঞ্চালন স্তিমিত হয়ে গেছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বন্ধে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করায় দেশে কালো টাকার সঞ্চালন কমাতে হচ্ছে। এর ফলে বাজেটেও আর অবৈধভাবে অর্জিত কালো টাকা আর সাদা করার সুযোগ দেয়া যাবে না। দেশে-বিদেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে কাজ করতে আন্তর্জাতিক সংস্থা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত চুক্তির কারণে এই সুযোগ দেয়ার কোনো সম্ভাবনা আর থাকল না। উল্টো কালো টাকা তৈরির সব পথ বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে বন্ধ করতে হবে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাতে কালো টাকা রাখা ও সঞ্চালনের সুযোগ।
তবে বৈধভাবে অর্জিত যে কালো টাকার আয়কর দেয়া হয়নি কেবল ওই টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া যাবে বাড়তি কর পরিশোধের মাধ্যমে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, দেশে-বিদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বন্ধ ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে সহায়তায় তথ্যের আদান-প্রদান করতে গত বছরের জুলাইয়ে এগমন্ট গ্র“পের সদস্য হয়েছে বাংলাদেশ। ওই গ্র“পের সদস্য হওয়ায় বাংলাদেশকে এখন এফএটিএফের ৪০টি সুপারিশ মেনে চলতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে কালো টাকা সাদা করার কোনো সুযোগ না দেয়া। কালো টাকা বিনিয়োগ বা লেনদেন করার ব্যবস্থাও রাখা যাবে না। গত ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে দুই বছরের জন্য কোনো শর্ত ছাড়াই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার ফলে এশিয়া প্যাসিফিক গ্র“প অন মানি লন্ডারিং তীব্র আপত্তি করে। পরে অবশ্য শর্তযুক্ত করে এই সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এর পর থেকে গত দুই বছর এই সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের তথ্য বাংলাদেশকে এপিজিপির কাছে পাঠাতে হয়েছে। ওই সময়ে বাংলাদেশ এগমন্ট গ্র“পের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করায় তারা বাংলাদেশকে মূল্যায়ন করছিল।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোঃ রাজী হাসান যুগান্তরকে বলেন, কালো টাকা রাখার সুযোগ এখন অনেক কমে এসেছে। এ ব্যাপারে আমরা এখন আন্তর্জাতিকভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছি। এর উৎপাদন, সঞ্চালন, মজুদ সবই বন্ধ করতে হবে। এগুলো না করলে আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের দুর্নাম হবে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী এখন সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন নিয়ে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হচ্ছে। যে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পেছনে অর্থের জোগন রয়েছে। এই জোগান বন্ধ করতে পারলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও কমে যাবে। এই জোগান আসে কালো টাকা থেকে। কালো টাকার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও সংহতির প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে এসেছে।
আন্তর্জাতিকভাবে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে কাজ করছে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ)। এটি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন ঠেকাতে নীতি প্রণয়নের কাজ করে। ওই নীতি বাস্তবায়ন করে এফএটিএফের সহযোগী সংস্থা এগমন্ট গ্র“প। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ওই নীতি বাস্তবায়নের দিক তদারকি করে এশিয়া প্যাসিফিক গ্র“প অন মানি লন্ডারিং (এপিজি)। বাংলাদেশকে এখন কালো টাকা নিয়ে ওই তিন প্রতিষ্ঠানের কাছেই জবাবদিহি করতে হয়।
ওইসব প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা অনুযায়ী এখন আর বাংলাদেশের বাজেটে ঘুষ, দুর্নীতি, চোরাচালানসহ বৈধ উৎস নেই এমনভাবে অর্জিত টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া যাবে না। তবে অপ্রদর্শিত আয় অর্থাৎ যে টাকা বৈধভাবে আয় করা, কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী আয়কর দিয়ে তা বৈধ করা হয়নি, কেবল ওই অংশটুকুই নির্ধারিত করের চেয়ে আরও বেশি কর দিয়ে সাদা করার সুযোগ দয়া যাবে। এই প্রক্রিয়ায়ও শুধু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আয়করের অংশটুকু ছাড় দিতে পারবে। এর বাইরে অন্য যে কোনো সংস্থা ওই টাকার পেছনে কোনো অপরাধ আছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে এবং তদন্তকারী সংস্থার কোনো বিধি লংঘিত হলে তারা ব্যবস্থা নিতে পারবে।
কালো টাকার সঞ্চালন কমছে : কালো টাকা এখন অনেক ক্ষেত্রেই রাখা যায় না। আগে বিয়ারার সার্টিফিকেট অব ডিপোজিটের (বিসিডি) আওতায় ব্যাংকে কালো টাকা রাখা যেত। এর আওতায় টাকা রাখলে কোনো নাম-ঠিকানা থাকত না। গ্রাহকদের শুধু একটি নম্বর দেয়া হতো। গ্রাহক মেয়াদ শেষে ওই নম্বর দেখিয়ে মুনাফাসহ টাকা নিয়ে যেত। মানি লন্ডারিং আইন-২০০২ সালে কার্যকর হওয়ার পর থেকে এটি তুলে দেয়া হয়। এখন বিয়ারার সার্টিফিকেটের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোতে কোনো কালো টাকা রাখা যায় না। ব্যাংকের অন্যান্য হিসাবে টাকা রাখলেও তার উৎস জানাতে হয়।
সরকারি সঞ্চয়পত্রে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেও এখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শনাক্ত করা যায়। কেননা এখন সঞ্চয়পত্র কিনতে ছবি লাগে এবং জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে হয়। বড় অংকের বিনিয়োগের লেনদেনে করতে হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। এছাড়া অন্য আইনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে। কয়েকটি সঞ্চয়পত্রে কালো টাকা বিনিয়োগ না করার বিধান রাখা হয়েছে। এর মধ্যে পেনশনার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে হলে টাকার উৎস জানাতে হয়।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান যুগান্তরকে বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার মানে হচ্ছে সৎ মানুষের কাছ থেকে কর আদায় করে অসৎ মানুষকে কর প্রদানে নিরুৎসাহিত করা। এতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন। এটি দেশের কর প্রশাসনের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলবে।
তিনি বলেন, এই সুযোগ বার বার দিলে কালো টাকা তৈরি হতে থাকবে। আগে কালো টাকা সৃষ্টি, সঞ্চালনের সব পথ বন্ধ করা উচিত।
জরিপ করা হবে : দেশে কালো টাকা নিয়ে আরও একটি জরিপ করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এটি করা হবে। ওই জরিপের ভিত্তিতে এ ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এর আগে ২০১০ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কালো টাকা নিয়ে একটি জরিপ করা হয়। ওই জরিপে দেশের অর্থনীতিতে সর্বনিু ৪৬ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৮১ শতাংশ কালো টাকা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
ভারতের অর্থনীতির একটি বড় অংশ রয়েছে কালো টাকা। সে দেশেও কালো টাকার ব্যাপারে সরকার যথেষ্ট নমনীয়। গত কংগ্রেস সরকার ভারত থেকে বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। যদিও বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত রাজনৈতিক ভিন্ন মতাদর্শের ব্যক্তিদের পাচার করা টাকা দেশে আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে নিয়মিতভাবে কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। আগেও দেয়া হয়েছে। এতে কতটুকু লাভবান হওয়া গেছে, এই সুযোগের লাভ-ক্ষতির হিসাব এবং নিয়মিতভাবে যারা কর দিচ্ছে তাদের ওপর কি ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এর কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। এক্ষেত্রে একটি মূল্যায়ন দরকার। সেটি ছাড়াই নিয়মিতভাবে এই সুযোগ দেয়া হচ্ছে। একটি জরিমানা নিয়ে করা হলেও মেনে নেয়া হতো। কালো টাকা সাদা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কোনোভাবেই ইতিবাচক ভূমিকা রাখে না।