Published in Naya Diganta on Friday, 4 July 2014.
লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁট করেও অর্জনে ব্যর্থ এনবিআর
হামিদ সরকার
বাজেটে উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেও শেষ পর্যন্ত তা অর্জিত হচ্ছে না। আদায় না হওযায় এমনকি মূল লক্ষ্যমাত্রা থেকে ১১ হাজার ৯০ কোটি টাকা কাটছাঁট করেও সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন করতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-জুন) পর্যন্ত আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ঘাটতি থাকছে ১০ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে রাজস্ব বোর্ডকে জুনে আয় দেখাতে হবে ২১ হাজার ৩৭৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। কিন্তু এটা কখনোই সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদেরা।
এনবিআর সূত্র জানায়, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকার এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের নির্ধারণ করে দেয় রাজস্ব বোর্ডকে। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বছরের বেশির ভাগ সময়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ধারাবাহিকভাবে রাজস্ব আহরণ কমতে থাকে। ফলে বাধ্য হয়ে সেই লক্ষ্যমাত্রা সংশোধিত বাজেটে ১১ হাজার ৯০ কোটি টাকা কমিয়ে এক লাখ ২৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর হিসাব অনুযায়ী প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-জুন) রাজস্ব আয়ের ল্যমাত্রা হয় এক লাখ ১৪ হাজার ৫৮৩ হাজার ৩৩ লাখ টাকা। কিন্তু এনবিআর আদায় করতে পেরেছে এক লাখ তিন হাজার ৬২৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা। ১১ মাসের হিসাবে এ ল্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি দাঁড়ায় ১০ হাজার ৯৫৭ কোটি দুই লাখ টাকা। আর অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ২১ হাজার ৩৭৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা আহরণ করতে। অর্থাৎ জুন মাসে একক কোনো মাসের ল্যমাত্রার তুলনায় দ্বিগুণ রাজস্ব আহরণ করতে হবে ঘাটতি পূরণ করতে হলে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, মে মাসে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ১২ হাজার ৯৩০ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা, যা ল্যমাত্রার চেয়ে দুই হাজার ৫১৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব এসেছে আয়কর বিভাগ থেকে। এই বিভাগ থেকে চার হাজার ৮৫৯ কোটি ১৫ লাখ টাকার রাজস্ব এসেছে তিন হাজার ৭৭৩ কোটি টাকার বিপরীতে। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চার হাজার ৬০৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা এসেছে মূসক থেকে। এখানে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৭০৩ কোটি টাকা বেশি আদায় হয়েছে।
রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা সংশোধনের সময় আয়কর বিভাগের আয় তিন হাজার ৯৪০ কোটি টাকা, আমদানিপর্যায়ে মূসক খাতে দ্ইু হাজার ৯১০ কোটি টাকা এবং স্থানীয়পর্যায়ে মূসক খাতে চার হাজার ১৫০ কোটি টাকা কমিয়ে আনা হয়।
আর সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নেয়া হয় বিভিন্ন পদক্ষেপ। কিন্তু কর অঞ্চলে পর্যবেক্ষণ বাড়ানো, করফাঁকি রোধে মাঠপর্যায়ে তৎপরতা বৃদ্ধি এবং আয়কর জমা দেয়ার সময়সীমা কয়েক দফা বাড়িয়েও লক্ষ্যমাত্রার মঞ্জিলে পৌঁছতে পারেনি। সবচেয়ে বেশি ঘাটতি আয়কর বিভাগে। এখানে ঘাটতি রয়েছে ছয় হাজার ৮৯০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। দ্বিতীয় মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট অনুবিভাগে। এ বিভাগে ১১ মাসে ঘাটতির পরিমাণ তিন হাজার ৯৪৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। তবে এ দিক থেকে একটু ব্যতিক্রম শুধু আমদানি ও রফতানি পর্যায়ে আহরণকৃত কর শুল্ক বিভাগ। এ বিভাগে ১১ মাস শেষে ঘাটতির পরিমাণ মাত্র ১৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
আদায় কম হওয়া প্রসঙ্গে এনবিআর বলছে, বছরের শুরু থেকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ব্যবসায়ী ও করদাতারা কর দিতে পারেনি। তা ছাড়া একই কারণে কম হয়েছে আমদানি-রফতানিও। ফলে এইসব খাতে যে পরিমাণ মূসক ও শুল্ক আসার কথা সেটা আমরা পাইনি। মে মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আহরণ অনেক বেশি হয়েছে। জুন মাসেও রাজস্ব আহরণ অনেকটা বৃদ্ধি পাবে। তবে তাতেও ঘাটতি কিছুটা থাকবে।
রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশ্লেষণ হলো, ২০১৩-১৪ অর্থবছর সরকারের রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ২৫.৩ শতাংশ। কিন্তু সরকার প্রথম দশ মাসে মাত্র ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, যা তাদের প্রাক্কলনের চেয়ে ১২ হাজার কোটি টাকা কম। লক্ষ্যমাত্রা কমানোর পরও বর্তমান প্রাক্কলনে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে আগামী দুই মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করতে হবে; যা কল্পনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। তবে শেষ পর্যন্ত রাজস্ব ঘাটতি চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো থেকেই যাবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।