Published in কালের কন্ঠ on Tuesday, 29 December 2015
ফিরে দেখা ২০১৫
অর্থনীতিতে স্বস্তির বছর – খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
এ বছর সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলোর ক্ষেত্রে এক ধরনের স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি গেছে এবং মোটামুটি বছরজুড়েই তা বিরাজ করেছে। কিন্তু এর সুবিধা উত্পাদন বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যতটা হওয়ার মতো প্রত্যাশা ছিল, তা পুরো মাত্রায় পাওয়া যায়নি। এ বছর দেশি ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদার ওঠানামার কারণে শিল্প খাতের উত্পাদনে ওঠানামা ঘটেছে। রপ্তানিমুখী শিল্প খাতগুলোতে এর একটা প্রতিক্রিয়া আমরা সারা বছর ধরেই লক্ষ করেছি। একই সঙ্গে রপ্ত্তানিমুখী শিল্প খাতগুলোতে মুদ্রাবিনিময় হারের প্রতিক্রিয়া হয়েছে। টাকা ডলারের বিপরীতে মোটামুটি শক্তিশালী ছিল। ফলে রপ্তানিতে কিছুটা হলেও একটা সামগ্রিক প্রভাব দেখা গেছে। আবার বিনিয়োগ ও উত্পাদন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছুটা শ্লথ থাকার প্রতিক্রিয়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারে এর প্রভাব পড়ে থাকতে পারে। এটি রেমিট্যান্টের শ্লথ প্রবৃদ্ধির কারণেও হতে পারে। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারনির্ভর শিল্পগুলোর উত্পাদনের যে প্রবৃদ্ধি তা কিছুটা হলেও শ্লথ ছিল বলে বছর শেষে তথ্য-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে। তবে স্বস্তির জায়গাটি হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী পেট্রোলিয়ামের কম দর বা ধারাবাহিক মূল্যপতনের ফলে সরকারের আমদানিজনিত ব্যয় কিছুটা সাশ্রয় হয়েছে; যদিও এর সুবিধাটি ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানো যায়নি। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রেও আমরা মোটামুটি স্বস্তিদায়কভাবে বছরটি শেষ করেছি। ভোক্তা পর্যায়েও হয়তো মানুষ সে সুবিধা পেয়েছে। তবে এই সুবিধাটি আরো বেশি পাওয়া যেত যদি মূল্যস্ফীতি আরো কিছুটা নিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে রাখা যেত। আমরা এও দেখেছি, সুদের হারের ক্ষেত্রে এক ধরনের শ্লথ পতন হয়েছে। তবে এখনো তা উচ্চ মাত্রায়ই রয়েছে। বিনিয়োগে সহায়ক যে সুদহার সাধারণত বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশা করেন, তা এখনো পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না।
গত বছরের অর্ধাংশ এবং এ বছরজুড়ে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ ও সেগুলো বাস্তবায়নকাল চলছে; যদিও সব কটির অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক বা সন্তোষজনক তা বলা যাবে না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি ও মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন বা শুরু হওয়া। তবে সমস্যা হচ্ছে, যে হারে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে সে হারে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে লিংকেজ ইফেক্ট অর্থাত্ ধনাত্মক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। এই লিংকেজ ইফেক্টকে ক্রাউডিং ইফেক্টও বলে। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সরকারকে আগামী দিনগুলোতে প্রকল্পের গুণমান দেখা এবং প্রকল্প সীমিত রাখার দিকে নজর দিতে হবে।
এ বছর আঞ্চলিক পর্যায়ের কিছু উদ্যোগেরও গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। চার দেশের মধ্যকার মোটর ভেহিকল অ্যাগ্রিমেন্টের টাইমফ্রেম হয়েছে। আমি মনে করি, এর একটা দীর্ঘমেয়াদি সুফল বাংলাদেশ আগামীতে পেতে পারে। তবে এটি বাস্তবায়ন করতে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে এবং এই বিনিয়োগের সঙ্গে সমন্বয় রেখে বাকি দেশগুলোকেও তাদের সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোয় বিনিয়োগ করতে হবে।
আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়ে সরকার নজর দিচ্ছে। জমিস্বল্পতার বিষয়টি মাথায় রেখে স্পেশাল ইকোনমিক জোন করার ক্ষেত্রে কিছু উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে উদ্যোগগুলো এখনো বেশ প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়ন যাতে আগামী এক বা দুই বছরের মধ্যে শেষ করা যায় সেদিকে আরো নজর দেওয়া দরকার। কারণ জমিস্বল্পতার কারণেও অনেক দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ এখান থেকে চলে যাচ্ছে। তবে দেশে উত্তরোত্তর নতুন বিনিয়োগ পরিবেশে জটিলতা বাড়ছে। নতুন বিনিয়োগকারীদের কথা মাথায় রেখে বিনিয়োগ পরিবেশ আরো উন্নত করার প্রয়োজন রয়েছে।
আরেকটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। দেরিতে হলেও ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট বাস্তবায়নের ওপর বছর শেষে গুরুত্ব দেওয়া হলো। এ আইন বাস্তবায়ন করা গেলে আমাদের পাটশিল্পের একটি বড় বাজার সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে। বাজার বড় হলে সরকারি ও বেসরকারি পাটকলগুলো চালানো ভায়াবল অবস্থায় যেতে পারে।
সব শেষে বলি, বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে। এটি আনন্দের বিষয়, আবার উদ্বেগেরও। কারণ এর মাধ্যমে নতুন ধরনের দায়িত্বের মধ্যে বাংলাদেশ উপনীত হচ্ছে। আগামীতে হয়তো সুদের হার বা ঋণের সুদ আদায়ের চাপটি বেড়ে যাবে। এ ছাড়া এই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ যদি এলডিসি থেকে বেরিয়ে যায়, তখন আমরা স্বল্পোন্নত দেশের বর্তমান সুবিধাগুলো হারাব। তবে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কিছু সুযোগও আমাদের তৈরি হয়েছে। যেমন পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স, শ্রমবিষয়ক কমপ্লায়েন্স—এই জায়গাগুলোতে উন্নতি করার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। তবে আমরা শুধু গার্মেন্ট খাতে এ জায়গাগুলোয় জোর দিচ্ছি। ভবিষ্যতে বাজার সুবিধা পেতে হলে গার্মেন্টের বাইরে অন্যান্য রপ্তানিমুখী খাতের কমপ্লায়েন্সের দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে। আবার নতুন নতুন জোট গঠনের উদ্যোগ আমরা দেখছি বিশ্বব্যাপী। এর ঋণাত্মক প্রভাবও বাংলাদেশে পড়তে পারে। নতুন চুক্তিগুলোর অভিঘাত বিবেচনা করে বাংলাদেশ কিভাবে আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংযোগের ক্ষেত্রে নতুন জোটের অংশ হতে পারে, এ নিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে, যাতে এ ধরনের বাণিজ্য আলোচনায় আরো ভালোভাবে অংশগ্রহণ সম্ভব হয়।
লেখক : অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক, সিপিডি (অনুলিখন)