Published in দৈনিক জনকন্ঠ on Friday, 1 April 2016
পরিপূর্ণতার কাহিনী
কামরুল হাসান শিপু
রেহমান সোবহানের বিক্ষিপ্ত স্মৃতির অতলে পরিতৃপ্ত এক অধ্যায়ের শেষ দিকের ঘটনা। ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর। যুদ্ধবিধ্বস্ত ঢাকার ধানম-িতে বন্ধু জিয়াউল হক টুলুর বাসায় থার্টিফার্স্ট নাইটের এক আনন্দঘন মুহূর্ত। বিশাল হলরুমে আগত অসংখ্য অতিথি। এদের অনেকেই রেহমান সোবহানের বন্ধু কিংবা বন্ধুর বন্ধু। অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে প্রত্যকে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর প্রতীক্ষায় জড়ো হয়েছেন। বিগত নয় মাসের এক অনামিশা যাত্রা পার করে এমন দিন যাপনের কথা কেউ ভাবতে পারেননি। এদের অনেকেই বিগত দিনগুলোতে স্বজন, পরিজন, বন্ধু কিংবা পরিচিতজনকে হারিয়েছেন। অনেকেই বসতভিটাসহ সহায় সম্বলহীন হয়েছেন। রেহমান সোবহানও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী তাঁর বাড়ি ঘর লুটপাট করে বিধ্বস্ত অবস্থায় রেখে যায়। তখনও পর্যন্ত তাঁর কোন স্থায়ী ঠিকানা ছিল না।
তারপরেও সেদিন রাতে কাউকে বিমর্ষ কিংবা নিঃস্ব মনে হয়নি। সকলেই স্বাধীনতা, নতুন দেশ, নতুন পতাকা পাওয়ার আনন্দে বিভোর ছিলেন। প্রত্যেকেই আশাবাদী ছিলেন আগামী দিনে নতুন সূর্যকে জয় করার।
সেই আকাঙ্খা নিয়ে সকলেই উচ্ছ্বসিত হয়ে হাতের গ্লাস টুকে চিয়ার্স বলেছেন। কিন্তু আগামী দিনগুলোয় চিয়ার্স করার মতো কিছু রইল না দেখে লেখক শেষে আফসোস করলেন। ১৯৭১ সালের থার্টিফার্স্ট নাইটেই লেখকের গল্প বলা শেষ হয়। আমরা সেই গল্পে মাত্র ৩৬ বছর বয়সী এক যুবকের পরিতৃপ্ত এক ঐতিহাসিক অধ্যায় খুঁজে পাই। একজন সফল ও আলোকিত মানুষের জীবন অভিজাত পরিম-লেও কতটা রোমাঞ্চকর হয় তা ভেবে শিহরিত হই। ‘আনট্রানক্যুয়াল রিকালেকশন : দি ইয়ার্স অব ফুলফিলমেন্ট’ তাঁর আত্মজীবনীমূলক বইয়ে।
ইংরেজী ভাষায় লেখা এ বই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। লেখক বইয়ের শুরুতেই বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। তাই ঐতিহাসিক ঘটনার উত্তাপ খুঁজতে গিয়ে পাঠক হতাশ হবেন না। বরং, ঐতিহাসিক ঘটনায় তাঁর সম্পৃক্ততা পাঠককে মুগ্ধ করবে এটা নিশ্চিত। রেহমান সোবহান ১৯৭১ সালে জাতিসংঘে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া ভারতীয় কূটনীতিকদের সঙ্গে প্রবাসী সরকারের প্রথম দিকের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকসমূহ তাঁর চেষ্টায় সম্ভব হয়।
১৯৬৬ সালে যে ক’জন অর্থনীতিবিদ আওয়ামী লীগের ছয় দফা প্রণয়নে কাজ করেছেন রেহমান সোবহান ছিলেন তাদের অন্যতম। উল্লেখ্য, ছয় দফার প্রথম চার দফাই ছিল অর্থনীতিভিত্তিক।
সেই ঘটনার বহু আগে রেহমান সোবহান পাকিস্তানের পূর্ব-পশ্চিম দুই প্রান্তে দুই অর্থনীতির থিওরি উপস্থাপন করেন। তার এই কাজে তৎকালীন বহু অর্থনীতিবিদ যুক্ত ছিলেন।
১৯৬১ সালের অক্টোবরে লাহোর সেমিনারে রেহমান সোবহানের উত্থাপিত ‘টু ইকোনমিক্সস’ (ঃড়ি বপড়হড়সরবং) তাঁকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে। ৬০ দশকের সেনাশাসনামলে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের এমন সাহসিকতা সত্যিই বিরল। তখন রেহমান সোবহানের বয়স মাত্র ২৬ বছর। তাঁর এ থিওরি স্বতন্ত্র কিংবা মৌলিক ছিল না কিন্তু, একটি পরিপাটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন ছিল। তাঁর এ কাজে সর্বজন শ্রদ্ধেয় আরও যে ক’জন অর্থনীতিবিদ যুক্ত ছিলেন তারা হলেন : ড. এ সাদেক, ড. নরুল ইসলাম, ড. হাবিবুর রহমান, ড. আখলাকুর রহমান, ড. মোশারফ হোসেইন, জনাব আবদুর রাজ্জাক, প্রফেসর এম এন হুদা, প্রফেসর এএফ এ হোসেইন। ১৯৫৮-৬২ সালের সামরিক শাসনে বিতর্কিত বিষয়সমূহ সাধারণত সেমিনার কিংবা প্রশাসনিক কাগজে সীমাবদ্ধ থাকত। তখন প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের সামালোচনা করার সুযোগ ছিল না। সেই গ-িবদ্ধ পরিম-লে রেহমান সোবহানসহ উল্লেখিত অর্থনীতিবিদরা সচেষ্ট থেকেছেন বাংলার অধিকার আদায়ে। পূর্ব-পশ্চিম দুই পাকিস্তানের অর্থনীতির বৈষম্য তুলে ধরে সাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। তৎকালীন পাকিস্তান প্লানিং কমিশনের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে বাধ্য করেছেন বাঙালী অর্থনীতিবিদদের উপদেশ গ্রহণ করতে। বাঙালী অর্থনীতিবিদদের প্রচেষ্টায় প্লানিং কমিশন পরবর্তীতে করাচী থেকে ঢাকায় সরিয়ে আনা হয়। ৬০ দশকে রেহমান সোবহান কেবল শিক্ষাবিদ ছিলেন না, তার পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিম-লেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। এ সময় ‘ফোরাম’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সঙ্গেও নিজেকে যুক্ত করেন রেহমান সোবহান। ড. কামাল হোসেন, জিয়াউল হক টুলু, হামিদা এবং রেহমান সোবহান ছিলেন এ পাত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ১৯৬৯ সালের ২২ নবেম্বর ফোরাম পত্রিকার প্রথম প্রকাশনার দিন এক হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে এ পত্রিকার আজীবন সদস্য হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণের ফলে এ পত্রিকার বিলুপ্তি ঘটে। পূর্ব ও পশ্চিম দুই পাকিস্তানের অসংখ্য রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের লেখায় সমৃদ্ধ থাকত এ পত্রিকা। ইংরেজী ভাষায় অনূদিত এ পত্রিকার সার্কুলেশন সর্বসাকূল্যে ছিল এক হাজার কপি। কিন্তু ফোরামের প্রভাব ছিল ব্যাপক।
এ পত্রিকার মাধ্যমে রেহমান সোবহান তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটান। ফোরাম পত্রিকায় অর্থনীতি বিষয়ক তাঁর বিভিন্ন লেখা অন্যান্য সম্পাদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। স্বনামধন্য সেসব পত্রিকায় বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিষয়ে তার মতামত ও বক্তব্য তখন নিয়মিত তুলে ধরা হতো।
একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে রেহমান সোবহান ৬০ দশকের শুরু থেকেই বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। অথচ ক্যামব্রিজ ফেরত রেহমান সোবহান করাচী থেকে যখন ঢাকায় আসেন তখন তাঁর বাংলা ভাষা সঠিকভাবে জানা ছিল না। শৈশব থেকে রেহমান সোবহান দার্জিলিংয়ের সেন্ট পোল বোর্ডিং স্কুল, লাহোরের এটিশন কলেজে পড়ার দরুন কিছুটা যাযাবর জীবন কাটিয়েছেন। বাবা-মার বিচ্ছেদও এমন জীবনের আরেকটি কারণ। ফলে তাঁর স্কুল-কলেজের ছুটির দিনগুলো কাটত কখনও পিতা কিংবা মায়ের দ্বিতীয় সংসারে । কোন স্থায়ী ঠিকানা ছিল না যৌবনে। অবশেষে বিয়ের পর ১৯৬৬ সালে গুলশানে তৈরি হয় তাঁর একটি স্থায়ী আবাস। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বত্র রাজনীতিক গোলযোগ বাড়তে থাকায় তখন তিনি ঢাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন । অবশেষে আইয়ূব শাহীর পতনের পর ১৯৬৯ সালে রেহমান সোবহান ঢাকা ফিরে এলে সেই থেকে গুলশানের বাড়িতেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাঁর প্রথম স্ত্রী সালমাকে সঙ্গে নিয়ে নিজ হাতে বাড়িটি সাজিয়েছেন । ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত পরিপাটি মানুষ রেহমান সোবহান। তাঁর রয়েছে পারিবারিক ঐতিহ্য ও ইতিহাস। তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের খন্দকার পরিবারের সদস্য । ইসলাম ধর্মের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) বংশধর তাঁর পরিবার। ইসলামের প্রথম খলিফার ৩১তম বংশধর হলো তাঁর পিতা খন্দকার ফজলে সোবহান। রেহমান সোবহানের মা ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবারের আত্মীয়। পূর্ব-পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ছিলেন তাঁর মাতামহীর সহোদর। এছাড়া তাঁর প্রথম স্ত্রী সালমা ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আত্মীয়। সালমার বাবা ছিলেন যুক্তরাজ্যে পাকিস্তানের হাইকমিশনার। ফলে বিভিন্ন অভিজাত পরিবারের সংমিশ্রণ ও পরিবেষ্টনের কারণে তিনি ছিলেন একজন স্বভাবজাত অভিজাত। এছাড়া তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরাও ছিলেন রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। ফলে তাঁদের কর্মপরিধি ও বিস্তৃত গ-ি রেহমান সোবহানের জীবনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। বইটি প্রকাশ করেছে সেজ পাবলিকেশন্স ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড।