Published in সমকাল on Tuesday, 31 May 2016
বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় হচ্ছে
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
বাংলাদেশের অর্থনীতিবিষয়ক আলোচনা সাধারণত আমাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ শক্তি ও দুর্বলতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির তুলনামূলক বিচার আমরা কমই করে থাকি। গত দেড় দশকের (২০০০-২০১৫) তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত সূচকগুলোর মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় বিশ্বের মোট উৎপাদন ও আয়ে বাংলাদেশ কীভাবে তার হিস্যা বাড়িয়ে চলেছে। যেমন, ২০০০ সালে বৈশ্বিক জিডিপিতে বাংলাদেশের অংশ ছিল প্রায় ০.১৬ শতাংশ, সেটা ২০১৪ সালে এসে দাঁড়ায় ০.২২ শতাংশে। একই রকমভাবে, বৈশ্বিক আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবদান ২০০০ সালে ০.১৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৪ সালে ০.২৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। লক্ষণীয়, উৎপাদনের তুলনায় আয়ের অংশে বাংলাদেশের অবদান বেশি; মনে রাখতে হবে সেটি সম্ভব হয়েছে প্রবাসী আয় যুক্ত হওয়ার কারণে। আমদানি-রফতানির বৈশ্বিক তথ্য বিশ্লেষণ করলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনুরূপ ঊর্ধ্বমুখী চিত্র পাওয়া যায়। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, মোট বৈশ্বিক রফতানিতে বাংলাদেশের অবদান ২০০০ সালের ০.০৮ শতাংশ থেকে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৪ সালে দাঁড়িয়েছে ০.১৪ শতাংশে। এমনকি ২০০৮-০৯ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটও এই ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটাতে পারেনি। একই সময়ে বৈশ্বিক আমদানিতে বাংলাদেশের অবদান ০.১১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ০.১৯ শতাংশ হয়েছে। এই আমদানি বৃদ্ধি অবশ্য কিছুটা কাঁচামাল সরবরাহের মাধ্যমে রফতানি বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। পণ্য রফতানির পাশাপাশি সেবা রফতানিতেও বাংলাদেশ তার অবস্থান কিছুটা সংহত করেছে। যেমন, বিশ্বের মোট প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ২০০০ সালে বাংলাদেশ যদি পেয়ে থাকে ১.৬ শতাংশ, ২০১৫ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ২.৬ শতাংশে। প্রবাসী আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মজীবী প্রবেশের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১০ সালে বিশ্বে মোট প্রবাসী কর্মজীবীর ২.৫ শতাংশের মতো যেত বাংলাদেশ থেকে; সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০১৩ সালে এসে এই অংশ দাঁড়িয়েছে ৩.০৬ শতাংশে। পণ্য ও সেবা রফতানি খাতের এই বিকাশের পাশাপাশি বৈশ্বিক মোট প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের, অল্প অল্প করে হলেও, একটি ক্রমবর্ধমান অংশ বাংলাদেশে আসছে। যেমন ২০০০ সালে যদি এর পরিমাণ ০.২ শতাংশ হয়ে থাকে, ২০১৪ সালে এই তুলনীয় সংখ্যা হয়েছে ০.১৬ শতাংশ। শিল্পোৎপাদন বা সেবা খাতের অবদান বৃদ্ধি পেলেও বাংলাদেশের কৃষি খাতের গুরুত্ব কখনও হ্রাস পায়নি। এ ক্ষেত্রে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অর্জন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২০০০ সালে যদি পৃথিবীর মোট চাল উৎপাদনের ৬.৩ শতাংশ বাংলাদেশ উৎপাদন করে থাকে, সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০১৩ সালে এই উৎপাদন ছিল ৬.৯ শতাংশ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রমহ্রাসমান কৃষিজ ভূমির প্রেক্ষিতে এ অর্জন বিশেষভাবেই উল্লেখযোগ্য। উৎপাদন ও বাণিজ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশ সামাজিক খাতেও, বিশেষ করে সম্ভাব্য গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, মাতৃ মৃত্যুহার রোধ, শিশু মৃত্যুহার রোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে অগ্রগতি সাধন করেছে। ২০০০ সালে পৃথিবীর সম্ভাব্য গড় আয়ুষ্কাল ৬৭.৩ বছর, এর বিপরীতে বাংলাদেশের ছিল ৬৫.৩ বছর। ২০১৪ সালে এসে দেখছি, বাংলাদেশের মানুষের সম্ভাব্য গড় আয়ুষ্কাল (৭১.৬ বছর) বৈশ্বিক গড় আয়ুষ্কালের (৭১.৫) সঙ্গে সমান হয়ে গেছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশের মাতৃ মৃত্যুহার ছিল বৈশ্বিক মাতৃ মৃত্যুহারের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। এর বিপরীতে ২০১৫ সালে এই হার বিশ্ব হারের চেয়ে ১৮.৫ শতাংশ কম। শিশু মৃত্যুর ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করি অনুরূপ প্রবণতা। ২০০০ সালে বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর হার ছিল ২১ শতাংশ বেশি। অপরদিকে, ২০১৫ সালে বিশ্বের গড় শিশু মৃত্যুহারের তুলনায়, বাংলাদেশের শিশু মৃত্যুহার ৩.২ শতাংশ কম। তবে দুঃখের সঙ্গে লক্ষণীয় যে, স্বাস্থ্য খাতে বিশ্বের বুকে তুলনামূলকভাবে আমরা যতখানি সাফল্য দেখাতে পেরেছি, শিক্ষা খাতে ততখানি নয়। পৃথিবীতে গড় সাক্ষরতার হার যখন ৯০ শতাংশের কাছাকাছি, তখন বাংলাদেশে তা মাত্র ৬০ শতাংশ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সাফল্যের এই বৈপরীত্য নিঃসন্দেহে আমাদের চিন্তিত করে তোলে। উদ্বেগের আরেকটি দিক হলো অর্থনীতি ও সামাজিক খাতে বাংলাদেশ যেমন তুলনামূলক সাফল্য লাভ করছে, বিশ্বের সুশাসন সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের মাপকাঠিতে কিন্তু তেমনভাবে উন্নতি করতে পারছে না। যেমন, ২০০১-০৫ সালে আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছি। সর্বশেষ, ২০১৫-তে এসে ১৬৮টি দেশের মধ্যে আমরা ছিলাম ১৩৯তম অবস্থানে। অর্থাৎ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মাঝে ১৩তম অবস্থান। বাংলাদেশে ব্যবসা অনুকূল পরিবেশ আছে কি-না সে মাপকাঠিতে ২০১০ সালে আমরা যদি ১৮৯টি দেশের ভেতর থেকে থাকি ১১৮তম অবস্থানে, ২০১৫ সালে সে অবস্থানের পতন ঘটে হয়েছে ১৭৪তম। পাশাপাশি, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে ১৭৮টি দেশের ভেতর ১৩৭তম, ২০১৫ সালে যা কি-না ছিল ১৩১তম। অর্থাৎ এই সূচকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ‘কার্যত স্বাধীন নয়’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই সূচকে থাকা পাঁচটি স্তরের মধ্যে নিচের দিক থেকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্তরে অবস্থান করছে, যার সর্বশেষ স্তরে রয়েছে ‘অবদমিত’ অর্থনীতির দেশগুলো। তবে সবচেয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তোলার মতো ব্যাপারটি হলো, ভঙ্গুর দেশের সূচকে বাংলাদেশের তুলনামূলক অবস্থান। এই সূচকে থাকা নয়টি ধাপের মধ্যে নিচের দিক থেকে বাংলাদেশ চতুর্থ ধাপে অবস্থান করছে। উপরের তথ্যের এই সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা থেকে এটি পরিষ্কার যে, আর্থ-সামাজিক খাতসমূহে গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অর্জিত সাফল্য বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু একটি দক্ষ ও স্থিতিশীল রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা ও একটি বাণিজ্য-বিনিয়োগ অনুকূল নীতি পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাৎপর্যপূর্ণভাবে পিছিয়ে আছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও পিছিয়ে যাচ্ছে। যদি শেষোক্ত ক্ষেত্রে আমরা আরও পারদর্শিতার পরিচয় দিতে পারি তাহলে নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে আরও গৌরব নিয়ে এগিয়ে যাবে।