উন্নয়নের দু’রকম বেদুঈন

ড. আনিস পারভেজ

অতিরিক্ত পরিচালক, সংলাপ ও যোগাযোগ, সিপিডি

দারিদ্র্য দূরীকরণের রোমান্টিক চিন্তা নিয়ে কিছু ব্যক্তিক উদ্যোগের সংগঠিত রূপ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। উন্নয়ন কর্মের এটি অর্ধেক চিত্র মাত্র। অন্য অর্ধেকে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সমাজতান্ত্রিক ফ্রন্টের ক্রমবর্ধমান অগ্রযাত্রায় শঙ্কিত পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য, যারা সবে মাত্র সাম্রাজ্য খুইয়েছে, তাদের সুচিন্তিত কৌশল যাতে উন্নয়নের ঢালে সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখা যায়। শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৫৩-র V-Aid অর্থাৎ গ্রামীণ সাহায্য প্রকল্প দিয়ে। এশিয়া ও ল্যাটিন আমারিকার দেশগুলোতে সম্ভাব্য সমাজতন্ত্রকে ঠেকাতে স্বৈরশাসকদের প্রভূত অর্থ দেয়া হয় গ্রামীণ সমাজে রিলিফ দিয়ে প্রথমত দারিদ্রকে একটা পর্যায়ে  স্থাণু করা, এবং সেই সাথে তৈরি করা একটি তাবেদারি গোষ্ঠী যাদের হাতে  গ্রামের কর্তৃত্ব কুক্ষিগত হবে। পাকিস্তানে, যার অংশ ছিল বর্তমানের বাংলাদেশ, স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বুনিয়াদী গণতন্ত্রের মুখোশে V-Aid-এর সহায়তায় এ কাজটিই করেছিল।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে জরুরি প্রয়োজন ছিল ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঘর ও ভেঙে যাওয়া সড়ক নির্মাণ এবং স্বাস্থ্যসেবা। সরকারের পাশাপাশি দু’একজন ব্যক্তি সীমিত পরিসরে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে এগিয়ে আসে। সময়ের যাত্রায় এ সমস্ত ব্যক্তিক উদ্যোগের ফল এদেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, যেমন ব্র্যাক এবং গণস্বাস্থ্য সংস্থা। প্রাতিষ্ঠানিকিকরণের জন্য এসব সংস্থার প্রয়োজন ছিল অর্থ ও কারিগরি সহায়তা, যা যোগাতে পাশ্চাত্যের দাতাদের অনুপ্রবেশ।

অর্থের শক্তি অনতিক্রান্ত। তাই স্বল্প সময়েই দাতানির্ভর হয়ে উঠলো উন্নয়ন কর্ম। দারিদ্র্য দূরীকরণের ব্যক্তিক রোমান্টিক স্পিরিট রূপান্তরিত হল পেশাদারিত্বে, যা নিয়ন্ত্রিত হত দাতাদের অনুগ্রহ ও পরামর্শে। দাতারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফর্মুলায় উন্নয়ন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার নামে মূলত একটি প্রাতিষ্ঠানিক ফাঁদ তৈরি করলো, যার প্রধান উদ্দেশ্য দুটি—আন্তর্জাতিক বলয়ে নিজেদের একটি উজ্জ্বল ইমেজ তৈরি করা, এবং উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে জটিলতর করা।

প্রথম দু’দশক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর স্থায়ী জনবল ছিল, যারা আর দশটি চাকরির মতোই প্রায় আড়াই দশক কাজের নিশ্চয়তা নিয়ে দক্ষতা ও কমিটমেন্ট সুদৃঢ় করে উন্নয়ন কর্মে আবদান রাখবে। এ চিত্রটি ৯০-এর দশক থেকে পাল্টে যাচ্ছে। এখন দাতারা প্রকল্প ভিত্তিক সাহায্য দেয়—সাধারনত দুই বা তিন বছরের প্রকল্প। প্রকল্পের জন্য জনবল নেয়া হয়। স্বল্প সময়ের চাকুরিতে কমিটমেন্ট আশা করা যায় না। প্রথম ছয় মাস চলে যায় প্রকল্প বুঝতে, এবং শেষ একবছর ব্যয়িত হয় পরবর্তী চাকরি খুঁজতে। চাকরি না পেলে দারিদ্র্য তো তাকেও ঘায়েল করবে। এরকম একটি পরিস্থিতিতে উন্নয়ন দূরাহত।

উপরন্তু, দুই বা তিন বছরে প্রকল্প এলাকার লোকজনের মধ্যে একটি সারহীন আশা উসকে দিয়ে সরে পড়ার ফলে উন্নয়ন নিয়ে যেমন জনগণের বিভ্রান্তি হয় তেমনি উন্নয়নের সাথে অর্থ ও অন্যান্য প্রাপ্তির গন্ধে কিছু ধুরন্ধর লোক নতুন ক্ষমতা বলয়ের সৃষ্টি করে। খুলনার পাইকগাছায় দেলুতি ইউনিয়ন এ নিরিখে একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ। তিরিশ বছর সেখানে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এক দল যায় তো বিরতি দিয়ে অন্য দল আসে। এলাকায় একটি সার্থান্বেষি দল তৈরি হয়েছে, কিন্তু তিন দশকে এলাকায় চোখে পড়ার মত কোন উন্নয়ন হয়নি।

উন্নয়ন কর্মীরা বেদুঈনের মতো এক প্রকল্প থেকে আরেক প্রকল্পে ঘুরে বেড়ায়, অহর্নিশ তাদের মগজে থাকে চলমান প্রকল্পের পরে অন্য প্রকল্পে চাকরি পাব তো! আরেকটি বেদুঈন দল আছে, যারা দাতা দেশের নাগরিক—মোটা বেতনে স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকলে গ্রামে যায়, দরিদ্র লোকগুলো তাদের ডাবের পানি দিয়ে আপ্যায়িত করে। বিকেলে এইসব বেদুঈন হোটেলের সুইমিং পুলে শরীর জুড়ায়।