Published in সকালের খবর on Saturday, 23 April 2016
তিন বছরেও পরিচয় মেলেনি হতভাগ্য ১০০ শ্রমিকের
এসএম আলমগীর
সাভারের ভয়াবহ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির তিন বছর পূর্তি হচ্ছে আগামীকাল ২৪ এপ্রিল। যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ১ হাজার ১৩৮ জন গার্মেন্টস শ্রমিক। আহত হয় প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন। দুর্ঘটনার তিন বছর পরও হতাহত শ্রমিক বা শ্রমিক পরিবারগুলো পায়নি যথাযথ ক্ষতিপূরণ। কেউ কেউ ক্ষতিপূরণের অর্থ পেলেও অনেকের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। এছাড়া তিন বছরেও পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি হতভাগ্য প্রায় ১০০ নিহত শ্রমিকের। এই পরিচয়হীন শ্রমিকদের স্বজনরা ক্ষতিপূরণের অর্থও পায়নি। এ কারণে সবচেয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে তারা। আর বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে, আবার কেউ সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেছে। সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে ফিরছে তাদের।
এদিকে রানা প্লাজার হতাহতদের ক্ষতিপূরণের জন্য ৪০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি মিললেও শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেছে ৩০ মিলিয়ন ডলার, টাকার অঙ্কে যা দাঁড়ায় ২৩৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে ২ হাজার ৮৩৫ জন হতাহত শ্রমিক ও স্বজনদের মধ্যে দেওয়া হয়েছে ১৮২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। কিন্তু এখনও ট্রাস্ট ফান্ডে জমা পড়ে রয়েছে ৫৩ কোটি টাকারও বেশি। অথচ হতাহত শ্রমিকদের অনেকেই এখনও ক্ষতিপূরণের অর্থ পায়নি।
গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র নেতারা গত তিন বছর ধরে অনেকটা হাত গুটিয়ে রেখেছেন। সংগঠনটির পক্ষ থেকে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ওই ভবনে থাকা পাঁচ গার্মেন্টস কারখানার বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের বেতন, আহতদের চিকিত্সার জন্য কিছু অর্থ ব্যয় এবং প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ২ কোটি টাকা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে। এছাড়া ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে আর কোনো ভূমিকা রাখেননি সংগঠনটির নেতারা। তাছাড়া বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের আবার চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলে তাও বাস্তবায়ন করেনি বিজিএমইএ। উল্টো অভিযোগ রয়েছে, রানা প্লাজার কোনো শ্রমিক আবার গার্মেন্টসে চাকরির জন্য গেলে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান সকালের খবরকে জানান, ব্যবসায়ী সংগঠন হিসেবে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় হতাহতদের পাশে যতটা দাঁড়ানো দরকার ছিল আমরা তার চেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছি। আমরা আহতদের চিকিত্সার ব্যবস্থা করেছি, বেতনের ব্যবস্থা করেছি, প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে অর্থ দিয়েছি এবং নিহত শ্রমিকদের সন্তানদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছি। তবে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের চাকরি দেওয়া হয়নি-এ অভিযোগ ঠিক নয়। কেউ চাকরির জন্য এলে আমরা সে ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেন এ বিষয়ে জানান, গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন হিসেবে রানা প্লাজার হতাহত শ্রমিকদের যে ধরনের সাপোর্ট দেওয়া দরকার ছিল বিজিএমইএ’র তা তারা করেনি। বিজিএমইএ’র উচিত ছিল ক্ষতিপূরণের অর্থ দেওয়া। অথচ তারা একটি টাকাও ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়নি।
অন্যদিকে আহত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন বছর পরও ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল বেলার সেই ভয়াবহ দৃশ্য ভুলতে পারেনি তারা। বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের কেউ পঙ্গু হয়েছে, কেউ সারাজীবনের জন্য মেরুদণ্ডে লোহার রড বয়ে বেড়াচ্ছে, আবার কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগলপ্রায়। এমনই একজন সাভারের জেসমিন। দুর্ঘটনায় তার ভেঙে যায় মেরুদণ্ড। এরপর ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চলে দীর্ঘদিনের চিকিত্সা। পরে নেওয়া হয় সিআরপিতে। কিন্তু স্বাভাবিক জীবনে আর ফেরা হয়নি তার। মেরুদণ্ডের মধ্যে স্থায়ীভাবে বসানো হয়েছে লোহার রড। এ কারণে সবসময় ব্যথায় কাতরাতে হয় তাকে এবং কোনো কাজ করার ক্ষমতা নেই তার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সকালের খবরকে তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে মনে হয় জীবনটাই শেষ করে দেই, এ যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না।’
সাভারের আরেক নারী শ্রমিক নিলুফার। রানা প্লাজা ধসের ফলে তার ডান পা একেবারে থেঁতলে যায়। চিকিত্সক বলেছিলেন পা কেটে ফেলতে; কিন্তু তাতে ক্যানসারের সম্ভাবনা থাকায় তাও করা যাচ্ছে না। পুরো ডান পায়ে প্লাস্টার করে রাখা। যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারি না। চোখ বুঝলে ভেসে ওঠে সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি। তিনি দুঃখ করে বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় যারা সামান্য আহত হয়েছিল তাদের অনেকেই ১০-১৫ লাখ টাকা পেয়েছে। কিন্তু আমরা চরমভাবে আহত হওয়ার পরও আর্থিক সহায়তা পেয়েছি মাত্র ২ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে আমাকে কিছুই দেওয়া হয়নি। এমনিক রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ক্ষতিপূরণের অর্থ দেওয়া হলেও আমি পাইনি। অথচ রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত নয়, এমনও অনেকে প্রচুর টাকা নিয়েছে।
রানা প্লাজার চতুর্থতলায় নিউওয়েভ বটম লিমিটেডে হেলপার পদে চাকরি করতেন পাবনার ভাঙ্গুরা থানার সাবানা খাতুন। দুর্ঘটনার দিন সকাল ৮টার আগেই তিনি প্রবেশ করেছিলেন রানা প্লাজায়। সবে কাজ শুরু করেছিলেন। হঠাত্ই কেঁপে ওঠে ভবনটি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল মাথার ওপর। চাপা পড়েন একটি বিমের নিচে। ভেঙে যায় হাত-পা এবং আঘাত লাগে মাথায়। সেই থেকেই অসহায় জীবনের শুরু। গত তিন বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন জীবনযন্ত্রণা। এখন তার জীবন সম্পূর্ণ অন্যের ওপর নির্ভরশীল। নিজের শরীরেরই যত্ন নিতে পারেন না, সেখানে তিন সন্তানের দেখভাল করবেন কীভাবে। সন্তানদের ঠিকমতো আদর-যত্ন না করতে পারা সাবানাকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দিচ্ছে বলে তিনি জানান। এভাবেই রানা প্লাজা দুর্ঘটনায়ূ আহত শত শত শ্রমিককে এখন কষ্টের জীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ধসে পড়ে রানা প্লাজা। ওই ভবনে ছিল নিউওয়েভ বটম, প্যানথম অ্যাপারেল, প্যানথম ট্যাক, আর্থ ট্যাক এবং নিউওয়েভ স্টাইল নামে পাঁচটি কারখানা। বিলসের হিসাব মতে, ওই পাঁচ কারখানায় শ্রমিক ছিল ৩ হাজার ৯৪১ জন। এর মধ্যে জীবিত ও আহত শ্রমিক উদ্ধার করা হয় ২ হাজার ৪৩৮ জনকে। প্রাণ হারায় ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক। নিখোঁজ হয় ৩৬৫ জন শ্রমিক। এর মধ্যে ডিএনএ টেস্ট করে ২৬৫ জনের পরিচয় নিশ্চিত করা গেলেও এখনও নিখোঁজ রয়েছে ১০০ জন।