Published in বাংলাদেশ প্রতিদিন on Monday, 27 June 2016
সাময়িক অসুবিধায় পড়বে বাংলাদেশ
নিজস্ব প্রতিবেদক
যুক্তরাজ্যের ঐতিহাসিক গণভোটে ইউরোপের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোটের সঙ্গে ৪১ বছরের সম্পর্ক ছিন্নের পক্ষে রায় হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য সাময়িক অসুবিধার সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন থিঙ্কট্যাঙ্ক খ্যাত বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির বিশেষ ফোলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে যুক্তরাজ্য বন্ধন ছিন্ন করায় প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় বাংলাদেশ চাপে পড়বে বলেও মনে করেন জাতিসংঘের জেনেভা কার্যালয়ে কাজ করা সাবেক এই দূত। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফোলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশকে যে বাজারসুবিধা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধীনে যুক্তরাজ্যে দেওয়া হয়ে থাকে, সেগুলো অব্যাহত থাকবে। তবে ব্রিটেনকে এ সুবিধা বাংলাদেশকে দেওয়ার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশি পণ্য পাঠাতে সীমান্তে কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি হয় কি না তা এখন দেখার বিষয়। তবে বাংলাদেশ সাময়িক যে অসুবিধার মধ্যে পড়বে, তা উত্তোরণে সরকারের উচিত হবে বেসরকারি খাতকে সঙ্গে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। দেশের সমাজ সচেতন এই সাবেক দূত ও অর্থনীতি বিশ্লেষক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ইতিমধ্যে পাউন্ডের দাম পড়েছে। ইউরোর দামও হয়তো কমবে। আরও দেখার বিষয় হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়ার ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি হয় কি না। বিশ্ব অর্থনীতি ও নিরাপত্তার ঐক্য ও বন্ধনে ফাটল ধরে কি না। আরও দেখার বিষয় হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে থাকা অন্য দেশগুলোও যুক্তরাজ্যের পথ ধরে বের হয়ে যায় কি না।
Published in যুগান্তর on Saturday, 25 June 2016
নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রফতানিতে
বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে পোশাক খাত * পুঁজিবাজারেও অস্থিরতার আশংকা
হামিদ বিশ্বাস ও সাদ্দাম হোসেন ইমরান
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়াটা বর্তমানে ‘টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। এ ‘বিচ্ছেদ’ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববাজারে পাউন্ড ও ইউরোর দরপতন ঘটে। এতে বাংলাদেশের রফতানিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, দেশের পুঁজিবাজারেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। এছাড়া অভিবাসন, রেমিটেন্স, কর্মসংস্থানসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে নানা অসুবিধা ও সংকট দেখা দিতে পারে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার যুগান্তরকে এমন আশংকার কথা জানিয়েছেন কয়েকজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার। পাশাপাশি আমদানি-রফতানিকারকদের মতে, ব্রিটেনের এ পট পরিবর্তনের ফলে ইউরোপের বাজারে পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা ব্যাহত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ইউরোপের বাজারে পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা ব্যাহত হতে পারে। সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে রফতানি। এছাড়া অভিবাসনে কিছুটা অভিঘাত আসতে পারে। পুঁজিবাজারেও আংশিক প্রভাব পড়বে। তবে বিদেশী বিনিয়োগ বেশি নেই বলে বড় কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন তিনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যুগান্তরকে বলেন, কাজটি বাংলাদেশের জন্য ভালো হয়নি। সাময়িকভাবে কিছু অসুবিধা হতে পারে। ব্রিটেনের ভেতর দিয়ে ইউরোপের বাজারে আমাদের যেতে হয়। আশা করি, তারা বাধা দেবে না। পাউন্ড দুর্বল হলে আমাদের সক্ষমতা কমে যায়। এ ঘটনায় ইউরোর দামও কমে যেতে পারে। এ সমস্যা সমাধানে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সরকারকে দ্রুত স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, এ সিদ্ধান্ত বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। কারণ, দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ পোশাক রফতানি হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রে। এক্ষেত্রে সতর্ক পর্যবেক্ষণ রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, পুুঁজিবাজারে কিছুটা অস্থিরতা আসতে পারে। তবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে রফতানি খাত।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এ ঘটনা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কারণ বিশ্ব অর্থনীতিতে এমনিতে মন্দা চলছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়াটা তার সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ হল। তার মতে, পোশাক খাতে এর প্রভাব বেশি পড়বে। অবিভক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের পোশাক খাতের চুক্তি ছিল। তা এখন নবায়ন করতে হবে। এক ধরনের টানাপোড়েন লেগে থাকতে পারে। সহসাই সমস্যাটির সমাধানও হচ্ছে না। কারণ যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার এ ঘোষণা কার্যকর হতে কমপক্ষে ২ বছর সময় লাগবে। কূটনৈতিক চতুরতার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দেন তিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নবিষয়ক বিশেষজ্ঞ জিল্লুল হাই রাজী বলেন, ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ব্যবসা খাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ার আশংকা তৈরি হয়েছে। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে সমঝোতা করতে হবে। নতুন করে আইনকানুন করার প্রয়োজন পড়তে পারে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে ব্রিটেনে গণভোট অনুষ্ঠিত হলেও এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে আরও অন্তত ২ বছর লাগবে। তিনি বলেন, আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বাণিজ্যে শুল্কমুক্ত যে সুবিধা পেতাম সেটা এখন কি হবে? এ প্রশ্নই নতুন করে দেখা দিয়েছে। তিনি মনে করেন, ব্যবসার দিক থেকে আমাদের দেশের প্রতিদ্বন্দ্বীরাও একইভাবে জিএসপিভুক্ত দেশগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এ কারণেই নতুন করে সমঝোতার বিষয়টি সামনে এসেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আন্ডারে আমরা ছোট আগ্নেয়াস্ত্রের শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছি। এটাও এখন নতুনভাবে সমঝোতা করতে হবে। তার মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকাকালীন যে সুবিধা বাংলাদেশ পেয়েছে ব্রিটেন বেরিয়ে যাওয়ার পর স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে কতখানি সুবিধা বহাল থাকবে সেটাই এখন বিবেচ্য বিষয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, পোশাক খাতে বড় ক্ষতি হবে না। তবে টানাপোড়েন লেগে থাকবে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে অভিবাসন। এতে কর্মসংস্থান কমে যাবে। রেমিটেন্সে প্রভাব পড়বে। দ্রুত কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।
ব্যাংকার ও বিশ্লেষক মামুন রশীদ যুগান্তরকে বলেন, তৈরি পোশাকসহ অনেক পণ্য শুল্কমুক্তভাবে রফতানি করা যেত এতদিন। এখন সেসব ঢেলে সাজাতে হবে।
পোশাক খাতের রফতানি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যুগান্তরকে বলেন, ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানির পর যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি রফতানি হতো। এ অঞ্চলে রফতানির পরিমাণ ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ ক্ষতির আশংকা রয়েছে তা নিরূপণ করা হয়নি। পরে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে এ সমস্যা থেকে উত্তরণে কী ধরনের নীতি সহায়তা দিতে হবে তা জানানো হবে।
বিকেএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি আসলাম সানি বলেন, বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে রিফর্মের কারণে পোশাকের ক্রেতা কমে গেছে। নতুন এ সিদ্ধান্তের ফলে ইউরোপের বাজারে পোশাক রফতানি ২ থেকে ৩ শতাংশ সংকুচিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। এছাড়া আরও বহুবিধ সমস্যা দেখা দেবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর ব্র্যান্ডগুলো ভবিষ্যতে ব্রিটেনে কর সুবিধা পাবে কিনা এবং উল্টোভাবে ব্রিটেনের ব্র্যান্ডগুলো ইইউতে কী সুবিধা পাবে, তার ওপর পোশাকের মার্কেট শেয়ার নির্ভর করছে। এছাড়া এ সিদ্ধান্তের কারণে নেদারল্যান্ডস, স্পেনসহ অন্যান্য দেশ ইইউ জোটে থাকা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ইইউতে পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রবণতার আশংকা রয়েছে।
রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে তৈরি পোশাক খাত তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে যাবে। ব্রিটেন ইইউ থেকে আলাদা হওয়ার খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ডলারের বিপরীতে পাউন্ড এবং ডলারের বিপরীতে ইউরোর দরপতন ঘটেছে যথাক্রমে ১০ শতাংশ ও ৭ শতাংশ। গত ৩০ বছরে এ ধরনের দরপতন হয়নি। ফলে ব্রিটেনে ইইউর বিনিয়োগ কমে যাবে। যার প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে। এতে ব্রিটেনের জনগণের ক্রয়ক্ষমতাও কমে যাবে। যার প্রভাব পড়বে দেশটির পোশাক আমদানিতে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানির পর যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় ক্রেতা হওয়ায় রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে মুদ্রার দরপতন হওয়ায় বাংলাদেশী রফতানিকারকদের সক্ষমতা কমে যাবে।
বিটিএমইর সহ-সভাপতি ফজলুল হক বলেন, রফতানিতে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা এ মুহূর্তে কিছু বলা যাবে না।
তবে যেহেতু আলাদা হওয়ার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ৭ শতাংশ মুদ্রা অবমূল্যায়ন হয়েছে- তাই বলা যায় পোশাক রফতানিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে সরকারকে পোশাক রফতানির নীতি-সহায়তাগুলো নিয়ে পুনরায় ভাবতে হবে।
বাংলাদেশ টেরি টাওয়াল অ্যান্ড লিনেন মেনুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) সাবেক সভাপতি খন্দকার আবদুল মোক্তাদির বলেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। অক্টোবরের পরে সমঝোতার ভিত্তিতে ব্রিটেন ইইউ থেকে আলাদা হয়ে যাবে। তবে ধারণা করা যায়, যেহেতু ব্রিটিশ পাউন্ডের দাম ৭ শতাংশ কমে গেছে তাই পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দেবে।
Published in মানবজমিন on Saturday, 25 June 2016
জিএসপি নিয়ে দুশ্চিন্তা
এমএম মাসুদ
গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বৃটেনের বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর হবে না বলেই মনে করছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ। সামপ্রতিক সময়ে রানা প্লাজা ধসসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যেও ইইউ’র বাজারে বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানিতে যে সুবিধা পেয়ে আসছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেটি বহাল থাকবে কি-না তা নিয়েই দুশ্চিন্তা তাদের।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, সামগ্রিকভাবে বৃটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে নানামুখী প্রভাব পড়বে। গতকাল রায় প্রকাশের পর মানবজমিনকে দেয়া এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় খ্যাতিমান ওই অর্থনীতিবিদ বলেন, বাণিজ্যিক দিক থেকে ইতিপূর্বে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেসব সুযোগ সুবিধা দিত বৃটেন আলাদাভাবে এখন সেটি দিবে কি-না? তা দেখতে হবে। এটি স্পষ্ট হতে হয়ত কিছুটা সময় লাগবে। তবে আমার ধারণা, বৃটেন বাংলাদেশকে সেই সুবিধাটি দিবে। দ্বিতীয়ত বৃটেনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের যেসব পণ্য ইউরোপের অন্যান্য দেশের বাজারে যেত সেগুলোর ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। কারণ, পরিবহন ও বীমা সংক্রান্ত নানাবিধ ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। তৃতীয়ত, পাউন্ডের দর পতন হয়েছে। ইউরোর দামও কিছুটা নেমে যাবে। এটা আমাদের বাণিজ্য সক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, আগে আমরা ইউরো বা পাউন্ড থেকে যে পরিমাণ টাকা পেতাম এখন তার চেয়ে কম টাকা পাব। এতে সব দেশেরই অর্থনীতি প্রভাবিত হবে। ড. দেবপ্রিয় বলেন, আরেকটি বিষয় নিয়ে আমি নিশ্চিত নই, তা হলো- বৃটেনের আলাদা হয়ে যাওয়ার ফলে ওই দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বৃদ্ধি হবে কি না? অনেকে বলছেন, যেহেতু ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে অভিবাসন কমে যাবে সেহেতু স্বল্পোন্নত দেশের শ্রমিকদের বৃটেনে যাওয়ার সুযোগ বাড়বে। কিন্তু এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই, কারণ, যে মনোভাবের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তটি বৃটিশ জনগণ নিল তা সেই সম্ভাবনার কথা বলে না।
এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ইইউ ও বৃটেনের বিচ্ছেদে ইতিমধ্যে বাজারে প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। ডলার ও অন্য মুদ্রার বিপরীতে পাউন্ড ও ইউরোর দর পতন হয়েছে। তিনি বলেন, এর ফলে ইইউতে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখি শিল্পের সক্ষমতা কমে আসবে। এ ছাড়া বৃটেনে বাংলাদেশি প্রবাসীসহ অন্য দেশের বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। কর্মসংস্থান কমে যাবে। একই সঙ্গে ক্রয় ক্ষমতা কমবে। সালাম মুর্শেদী মতে, এতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবেন। জিএসপি বিষয়ে ইএবি সভাপতি বলেন, যেহেতু তাদের সঙ্গে একটি চুক্তি আছে। তাই এখন তারা জিএসপি বাতিল করবে বলে মনে হয় না। তবে আমরা সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তের মুখে ও চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়বো। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও বৃটেনের মাঝে বিভক্তি বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক প্রভাব তো পড়বেই। এতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ ইতিমধ্যেই পাউন্ডের দর পতন হয়েছে। ইউরোর পতন হয়েছে ৮%। ডলারে হয়েছে ১০%। ফলে এখন আমরা দেশীয় মুদ্রা টাকায় অর্থ কম পাবো। অর্থাৎ এখনই আমাদের বাণিজ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব লক্ষ্য করছি। অন্যদিকে রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে ইইউ বাংলাদেশের তৃতীয় দেশ। এই দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে বছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। সে হেসেবে আমাদের দেশের রপ্তানি বাণিজ্য ইইউ’র দেশগুলোতে কতটা বাড়বে বা কমবে ভবিষ্যতে তা আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে। তিনি বলেন, ইইউতে বর্তমানে আমাদের জিএসপি সুবিধা বহাল আছে। কিন্তু আগামীতে এটা থাকবে কিনা এনিয়ে এখনই চিন্তায় ফেলে দিয়েছে বলে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিজিএমইএ সভাপতি।
এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় ঐক্যের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়াটা গণভোটে নিশ্চিত হওয়ায় বৈশ্বিক অর্থ বাজার বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেয়েছে। ইইউ থেকে বিচ্ছেদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের নাটকীয় দরপতন হয়েছে। পাউন্ডের ইতিহাসে ডলারের বিপরীতে একদিনে সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছে এদিন। এক পর্যায়ে পাউন্ডের এর দর ১০ শতাংশ কমে ১.৩৩০৫ ডলারে নেমে আসে, যা ১৯৮৫ সালের পর সর্বোচ্চ দরপতন। পুরো ইউরোপজুড়ে শেয়ারবাজারগুলো ব্যাপক দরপতন নিয়েই চালু হবে বলে ফিউচার্স ট্রেডিংয়ের পূর্বাভাস। বৃটেনের এফটিএসই ফিউচার্স ও জার্মানির ড্যাক্স ফিউচার্স প্রায় ৯ শতাংশ দর হারিয়েছে। ইউরো জোনের ইউরো স্টক্স ৫০ ফিউচার্সের দর ১১ শতাংশের বেশি পড়েছে। পাউন্ডের দর কমায় বিদেশ থেকে আমদানিতে বেশি গুনতে হবে বৃটেনকে; অন্যদিকে পণ্যের দাম সস্তা হওয়ায় লাভবান হবে দেশটির রপ্তানিকারকরা। ইউরোর বিপরীতে পাউন্ডের দর প্রায় ৭ শতাংশ কমে ১.২০৮৫ ইউরোতে নেমেছে।
Published in আমাদের সময় on Saturday, 25 June 2016
ইইউ থেকে ব্রিটেনের বের হওয়া বাংলাদেশের জন্য উপকারী নয় -ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পে ৫২ শতাংশ ভোট পড়ায় ইইউয়ের সঙ্গে ৪১ বছরের সম্পর্ক শেষ হতে যাচ্ছে ব্রিটেনের। আর একে বাংলাদেশের জন্য উপকারী নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। গতকাল সংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, আগে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাণিজ্যিক দিক থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা দিত তা ব্রিটেন আলাদাভাবে দেবে কি না সেটি স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, ব্রিটেনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের যেসব পণ্য ইউরোপের অন্যান্য দেশের বাজারে যেত সেগুলোর ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। কারণ, পরিবহন ও বীমা সংক্রান্ত নানাবিধ ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া পাউন্ডের দর পতন হয়েছে। ইউরোর দামও কিছুটা নেমে যাবে। এটা আমাদের বাণিজ্য সমতার উপর প্রভাব ফেলবে। আগে আমরা ইউরো বা পাউন্ড থেকে যে পরিমাণ টাকা পেতাম এখন তার চেয়ে কম টাকা পাব। এতে সব দেশেরই অর্থনীতি প্রভাবিত হবে।
Published in আমাদের অর্থনীতি on Saturday, 25 June 2016
ব্রেক্সিট : বাংলাদেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে
উম্মুল ওয়ারা সুইটি
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্য আলাদা হওয়ায় বাংলাদেশে রপ্তানির উপর সাময়িকভাবে হলেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। কারণ বাংলাদেশ বর্তমানে ইইউর বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত পণ্য রফতানি করে। ইউরোপের অনেক দেশেই বাংলাদেশের পণ্য যুক্তরাজ্যের মধ্য দিয়ে যায়। তাছাড়া জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় এখন যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও বাংলাদেশকে নতুন করে আলোচনা করতে হবে। কূটনৈতিক মহল ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানি ছাড়াও যুক্তরাজ্যের এই বেরিয়ে যাওয়ার ফলে দেশের আর্থিক ও রাজনৈতিক খাতেও প্রভাব পড়বে। কারণ এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে নতুন মেরুকরণ হবে। ফলে বাংলাদেশের জন্য নতুন করে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে হিসাবে বসতে হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাবেক বাণিজ্যসংক্রান্ত কর্মকর্তা জিল্লুল হাই রাজি বলেছেন, আমি মনে করি এই ঘটনার ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের উপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইইউ বাজারে বাংলাদেশের বার্ষিক রপ্তানির পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ইউরো যা রপ্তানির অর্ধেকের বেশি । কাজেই এখন এই দর কষাকষিটা হয়তো নতুন করে করতে হবে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. তৌফিক আলী বলেছেন, বাংলাদেশের উপর বাণিজ্যিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রভাব পড়বে। বর্তমানে ইইউর বাজারে রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। আলাদা হয়ে যাওয়ায় যুক্তরাজ্য সেই সুবিধা রাখবে কিনা তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখন দ্বি-পক্ষীয়ভাবে। তিনি আরও বলেন, এরমধ্যে যদি যুক্তরাজ্য আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে বাংলাদেশের জন্য এটি নতুন পরিস্থিতি।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এটি বাংলাদেশের জন্য উপকারী হবে না। আবার এও বলা যাবে না, বাংলাদেশের রপ্তানি সুবিধা চলে যাবে। কেননা ব্রিটিশ সরকারের উন্নয়ন নীতিতে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে এই সুবিধা দেওয়ার কথা আছে। দেবপ্রিয় বলেন, রপ্তানিতে পরিবহন, বিমা ও আর্থিক ব্যয় বাড়বে। আবার ইউরো দুর্বল হয়ে গেলে বাংলাদেশের রপ্তানির আয়ে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ছে না। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হলে খারাপই হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বর্তমানে মানবাধিকারসহ অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যুত ইইউর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যুক্তরাজ্যও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ করে। আলাদা হওয়ার ফলে এ বিষয়ে নতুন করে আলাপ করতে হবে। যুক্তরাজ্য থেকে সাহায্য কীভাবে আসবেÑ তাও নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে। আলাদা হওয়ার পর তাদের কূটনৈতিক পলিসি কী হবে, সেটাও একটা বড় ব্যাপার। কাজেই একটা সেট করা সিদ্ধান্তকে আবার নতুন করে ঠিক করতে হবে।