রাজু নুরুল
উন্নয়নকর্মী
E-mail: raju_norul@yahoo.com
‘বাজেট আসছে’ – শুনলেই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলে আসা দিনগুলির কথা মনে পড়ে!
মে মাস আসলেই আরেক দফা বিড়ি-সিগারেটের দাম বৃদ্ধি এবং বন্ধু-বান্ধবদের শুকনো মুখ! এ প্রসঙ্গে আমাদের দুই গ্রাম পরের হালিম কাকার কৌশলটা মন্দ ছিলনা! বাজেটের মাস দুয়েক আগে জমজমাট ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। নির্বাচন শেষে আবিস্কার করা গেল যে, হালিম কাকার খাটের নিচে মাটির কলসি ভর্তি আকিজ বিড়ি! শুকনো ত্যানা দিয়ে মুখ আটকানো। ঘটনা কী? এতো বিড়ি হালিম কাকা পেলেন কোথায়? এত বিড়ি এভাবে মজুত করারই বা কারণ কি? জানা গেল, সামনেই বাজেট! অবধারিতভাবেই বিড়ির দাম বাড়বে আরেক দফা। আপদকালীন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন দলের মিছিলে অংশগ্রহণ বাবদ বিড়ির এই মজুত! হালিম কাকাতো ফ্রি বিড়ির মজুত রেখেছিলেন, কিন্তু বাজেটকে সামনে রেখে রুই-কাতলার মজুত যারা রাখেন, তাদের নামধাম কখনোই জানা হয়না আমাদের!
বাজেট নিতান্তই বড়দের জিনিস। বড় লোকদেরও বটে! জ্ঞানী-গুনীদের কারবার। বিশ্ববিদ্যালয়ে, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে প্রাক-বাজেট বক্তৃতা হয়, সেখানে আবার জ্ঞানগর্ভ আলোচনাও হয়। টেলিভিশনগুলো চুল-দাড়ি পাকাদের ডাকে। তারা কী কী যেন ‘ডিমান্ড’ আর ‘সাপ্লাই’ নিয়ে কথাবার্তা বলে। পত্রিকার পাতায় চক্রাবক্রা আঁকাআকি শুরু হয়। আর দরিদ্র মানুষেরা বুঝে, অর্থমন্ত্রীর হাতে ওই কালো ব্রিফকেস মানে জিনিসপত্রের আরেক দফা দাম বাড়া। এবার আবার বাজার দৌড়াবে। বাজারের সাথে সাথে তাকেও দৌড়াতে হবে! অর্থমন্ত্রী আজ বিকেলে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার যেটা ঘোষণা করবেন।
বাজেট মানে করের বোঝা! আয় করবেন আপনি, আর কেটে রাখবে সরকার! ছোট- বড় নানা ধরনের, নানা কৌশলে কর আরোপ।
ছোট্ট ছেলেটা বিধাতার কাছে রোজ প্রার্থনা করে, ‘প্রভু, আমাকে মাত্র ৫০০টা টাকা দাও। আমার আর কিছু চাই না।’ কিন্তু টাকা আর আসে না। তারপর বুদ্ধি করে একদিন সে বিধাতাকে একটা চিঠি লিখল। সেই চিঠি ডাকঘরে পড়ে রইল কিছুদিন। তারপর একদিন সহৃদয় কোনো একজন পড়ে থাকা চিঠিটা খুলে পড়লেন এবং পাঠিয়ে দিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে। আশ্চর্য ঘটনা হলো, সেই চিঠি গিয়ে পড়ল শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর হাতে। তিনিও মজা করে ২০০ টাকা পাঠিয়ে দিলেন, সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর একটা স্বাক্ষর। ২০০ টাকা পেয়ে মহাখুশি ছেলেটি। হাত তুলে মোনাজাত ধরে অভিযোগ করল, ‘প্রভু, টাকাটা অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে কেন পাঠালে, তিনি তো ৩০০ টাকা ট্যাক্স কেটে রেখেছেন।’
ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করলে বুঝা যায়, দুনিয়ার তাবৎ কৌতুক মনে হয় অর্থনীতিবিদদের নিয়েই। একজন গণিতবিদ, একজন হিসাবরক্ষক, আরেকজন অর্থনীতিবিদ আবেদন করেছেন একটা পদের জন্য। তাঁরা একে একে হাজির হলেন ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে।
– দুই আর দুই যোগ করলে কত হয়? প্রশ্নকর্তা গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করছেন।
– গণিতবিদ বললেন, দুই আর দুইয়ে চার হয়।
– হিসাবরক্ষক বললেন, দুই আর দুই যোগ করলে গড়ে চার আসবে। তবে টেন পারসেন্ট এদিক-সেদিক হতে পারে।
– আর অর্থনীতিবিদ ঝুঁকে বসলেন প্রশ্নকর্তার দিকে। স্যার, আপনিই বলুন, দুই আর দুইয়ে ঠিক কত হলে আপনার সুবিধা হয়!
বাজেট আসলে প্রতিবারই মনে হয়, এবার ভালো কিছু হবেই হবে। যাঁরা আশাবাদী, তাঁরা আশায় থাকেন। দরিদ্রের আক্ষেপ আর ফুরোয় না। ‘গরিবদের আর যত কষ্টই থাক না কেন, একটা বড় সুবিধা আছে। গরিব থাকার জন্য কোনো খরচা লাগে না।’ স্কটল্যান্ডের এই প্রবাদটা মানলেই তো আক্ষেপ কমে আসে! অথবা আদার ব্যাপারির জাহাজের খবর না নেয়ার মতোই, দরিদ্র মানুষেরা বাজেট নিয়ে মাথা না ঘামানোই মঙ্গল! চলুন আরেকটা গল্প শুনি:
হঠাৎ লোকসানের মুখে পড়া এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি কর্মচারীদের বার্ষিক বোনাসের বাজেট বাঁচাতে একটা নোটিশ টাঙালো— আপনি যদি দামি কাপড় পরে অফিসে আসেন, তাহলে আমরা বুঝবো আপনি খুবই সচ্ছল, বোনাসের এই সামান্য ক’টা টাকা না হলেও আপনার চলবে। আপনি যদি আজেবাজে কাপড় পরে অফিসে আসেন, তাহলে আমরা বুঝব, আপনি ফালতু খরচ করেন। তাই বার্ষিক বোনাসের টাকা আপনাকে দেওয়া হবে না। কেননা আপনি সেটাও উড়িয়ে দেবেন। আপনি যদি একদম ঠিকঠাক কাপড় পরে অফিসে আসেন, সে ক্ষেত্রে আমরা বুঝব, আপনি বেশ ভালোই আছেন। তাহলে বোনাসের টাকা নিয়ে করবেনটা কী শুনি?
সারমর্ম হলো, এই যে বাজেট নিয়ে এত বাগাড়ম্বর, তার প্রধান উপকারভোগী সম্ভবত: ধনীক শ্রেণী। যারা ভালো আছে, তারা আরো ভাল থাকবে। কিন্তু যাদের করের টাকায়, শুল্কের টাকায় এই মহা বাজেট, তাদের হয়রানি কি শেষ হবে?
শেষ করার আগে বাজেট নিয়ে লেখা সেই বিখ্যাত ছড়া-
‘বাজেট বাজেট মরার বাজেট
বাজেট আলুর দম
বড়র পাতে পড়ল বেশি
ছোটর পাতে কম।’
সবাইকে বাজেট মোবারক!