কৃষিতে নারীর অবদান ও তার মূল্যায়ন

Photo Credit: Ashik Masud

জিশান আরা মিতু

প্রোগ্রাম আসোসিয়েট, রিসার্চ, সিপিডি 

প্রাচীন যুগে যেখানে নারীর হাতে বোনা বীজ দিয়ে চাষাবাদের প্রচলন হয়েছে, মানুষ পশুপালন সভ্যতা থেকে কৃষি সভ্যতার দিকে এগিয়ে গিয়েছে, সেখানে কৃষিক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা কতটুকু তা সহজেই অনুমেয়। গ্রাম বাংলার নারীদের কাছেও অনেক কাজের মধ্যে কৃষিই গুরুত্বপূর্ণ। বীজ সংরক্ষন ও বপন থেকে শুরু করে, চারা রোপণ, সেচ, ফসল উত্তলন এমনকি বিপণনেও নারীরা এককভাবে ভূমিকা পালন করে থাকে।

আইএলও (ILO) শ্রমশক্তি জরীপ ২০১৩ অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট এক কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের মধ্যে ৭৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৯২ লাখ নারীই কৃষিকাজ, মৎস্যচাষ ও সামাজিক বনায়নের সাথে জড়িত। বিবিএস এর তথ্য পর্যালোচনা করলেও দেখা যাবে যে সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় (কৃষি-বন-মৎস্য খাত) নারীর অংশগ্রহণ অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছে।  তবে কষ্টের বিষয় হল, প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে কৃষিখাতে এ বিপুল জনগোষ্ঠীর দেয় শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না। যেসব নারীরা দিনমজুর হিসেবে অন্যের জমিতে কাজ করে তারা প্রতিনিয়তই মজুরী বৈষম্যের শিকার হয়, সেই সাথে রয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে তাদেরকে কাজে নিয়জিত রাখা এবং অন্যান্য মানসিক নিপীড়ন। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ৩৪৫ ধারা অনুযায়ী, নারীপুরুষের সমকাজে সমান মজুরি প্রদানের কথা থাকলেও, চারা রোপণ ও ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে পুরুষদের দৈনিক মজুরি যেখানে ৩০০-৬০০ টাকা, নারীরা সেখানে পায় মাত্র ৩৫০ টাকার মতো। কাজেই, আপাতদৃষ্টিতে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির পেছনে নারীর ক্ষমতায়নের কথা মনে হলেও এর মূল নেপথ্যে রয়েছে স্বল্প মজুরি দিয়ে দীর্ঘক্ষণ কাজ করানোর সুবিধা।

এদিক দিয়ে যারা নিজ জমিতে শ্রম দেয়, তাদের চাষাবাদের কাজে নিযুক্ত হবার বিষয়টি বর্তমান সভ্য সমাজেও নারীদের প্রাত্যহিক কাজের অংশ হিসেবেই ধরা হয়, মজুরী প্রদানের বিষয়টি সেখানে নিতান্তই হাস্যকর। বাংলাদেশ জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ তে, নারীর সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রণীত ২২ টি লক্ষ্যের মধ্যে নবম লক্ষ্যটি হল সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে নারীর অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করা, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে কৃষিখাতে নারী শ্রমিকের কোন বৈধ পরিচিতি নেই। পাঠ্যপুস্তকের কবিতায় কিষাণ–কিষাণী শব্দের ব্যবহার থাকলেও, প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ‘কিষাণী’ শব্দটির কোন ব্যবহার নেই। তবে কি ধরে নেওয়া যায়, নারীর কাজের মর্যাদা পূর্বের তুলনায় কমে গেছে নাকি সাহিত্যিকরাই কেবল তাদের কাজের মূল্যায়ন করতে পারে, তাদের আর্থ-সামাজিক নিপীড়নের কথা লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরতে পারে? সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব যাদের, তাদের কি কিছু করার নেই নারীর কাজের সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে?

২০১৬ সালের সিএসআরএল এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, কৃষিখাতের ২১ ধরনের কাজের মধ্যে ১৭ ধরনের কাজেই গ্রামীণ নারীরা অংশগ্রহন করে। অথচ কৃষি তথ্য সার্ভিস এর ‘কৃষিতে নারী’ শীর্ষক প্রতিবেদনে কৃষি জমির মালিকানায় নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ১৯ শতাংশ। সিপিডি’র গবেষণা প্রতিবেদন থেকেও উঠে এসেছে যে, নারীরা পুরুষের তুলনায় ৩ গুন বেশি কাজ করে। অন্যদিকে যে সব নারীরা অবৈতনিক ভাবে কৃষিখাতে ও পারিবারিক শ্রমে জড়িত তাদের সিংহভাগই মজুরি নিয়ে অন্যের জমিতে কাজ করতে আগ্রহি নয়। যার পেছনে প্রধান কারণগুলো হল পারিবারিক অসম্মতি, কাজের অবমূল্যায়ন ও মজুরি বৈষম্য। পারিবারিক অসম্মতির বিষয়টি অনেকটা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা মুখে না বললেও তারা বুঝিয়ে দেয় যে নারীদেরকে সন্তান লালন পালন ও ঘরের কাজ সামলে নিয়েই বাহিরের কাজ করতে হবে। সেক্ষেত্রে একজন নারীর পক্ষে সারাদিন বাড়ির বাইরে থেকে অন্যের জমিতে শ্রম দেয়া কঠিন হয়ে পরে। যার ফলশ্রুতিতে নারীরা না পায় গৃহস্থালীর কাজের মর্যাদা না পায় কৃষিখাতে প্রদেয় শ্রমিকের কাজের মর্যাদা। নারীদের শ্রম মূলত গ্রামীণ কৃষি-অর্থনীতিতে পরিবারের আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়না, বরং ফসল উৎপাদনে সামগ্রিক ব্যয় হ্রাসের উৎস হিসেবে তা পরিগনিত হয়।

কাজেই কৃষি তথা দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য নারীদের কাজের মূল্যায়ন তাদেরকে শুধুমাত্র নারী হিসেবে বিবেচনা করে নয়, মূল্যায়ন করা উচিৎ তাদের সামগ্রিক দক্ষতাকে বিবেচনায় এনে। এটা শুধুমাত্র কৃষিখাতেই নয় সব খাতেই এটি বিবেচ্য,  এবং অবশ্যই বিবেচ্য সব দেশে। সেই সাথে আমাদের ভেবে দেখা উচিৎ, ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ, আমেরিকায় নারীরা তাদের যেসব মৌলিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছিল তার কততুকু ২০১৮ তে এসে বাস্তবায়িত হয়েছে!