Published in The Daily Janakantha on Wednesday, 17 September 2014.
বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট দূর করার উদ্যোগ
কর্মকৌশল নির্ধারণে আজ পরামর্শক কমিটির বৈঠক
এম শাহজাহান
বেসরকারী খাতের বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট দূর করার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। পাশাপাশি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির ওপর জোর দিতে নতুন কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হবে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ও বাণিজ্য সংক্রান্ত যেসব আইনকানুন রয়েছে তা মেনে চলার পরামর্শ দেয়া হবে। আর এই কর্মকৌশল নির্ধারণে ব্যবসায়ীদের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। এছাড়া অবকাঠামো উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে দেশে একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে।
এ লক্ষ্যে বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটির মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ করে সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। আজ বুধবার বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটির জরুরী সভা আহ্বান করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সে অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়েনি। যদিও বিদেশী বিনিয়োগ ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। দেশী বিনিয়োগ না বাড়ার কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সম্প্রতি জাপানী প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বাংলাদেশ সফরের সময় ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছেন। একই সঙ্গে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) পক্ষে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক জরিপে অবকাঠামোর অপর্যাপ্ততা, দুর্নীতি ও অদক্ষ আমলাতন্ত্রকে ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রধান তিনটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। এবার তাই ব্যবসায়ীদের মতামত নিয়েই ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি এবং আস্থার সঙ্কট দূরীকরণে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সম্পর্ক খারাপ নয়। বরং বর্তমান সময়ে ব্যবসায়ীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে। আর এ কারণেই দেশের রফতানি বাড়ছে ও নতুন বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে। যেখানে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা রয়েছেন।
ইতোমধ্যে এ কমিটির একটি বৈঠক করা হয়েছে। আবারও আরেকটি বৈঠক আহ্বান করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠকে তাঁদের মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ করে সে অনুযায়ী কর্মকৌশল নির্ধারণ করবে সরকার। তিনি বলেন, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধিতে বর্তমান সরকার সব সময় আন্তরিক। বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে সরকারকে পরামর্শ প্রদান করবে। বাণিজ্যমন্ত্রী তাঁদের যে কোন পরামর্শ গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে কাজ করবেন। তাই এ কমিটি প্রয়োজন অনুযায়ী সময়ে সময়ে সভা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মন্ত্রীকে পরামর্শ প্রদান করতে পারবেন।
জানা গেছে, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটি গঠন করে। ২৫ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটি বাণিজ্যমন্ত্রীকে পরামর্শ প্রদান করছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে কমিটির মতামত ও পরামর্শ গুরুত্বসহকারে সরকার গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শিল্পের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি, বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে স্বল্প সুদে ঋণ, অবকাঠামো ও ইউটিলিটি সার্ভিস উন্নয়নসহ আগামী ৫ বছর মেয়াদী ক্রাশ প্রোগাম গ্রহণ করেছে সরকার। এ প্রোগাম বাস্তবায়নে বাণিজ্য সম্প্রসারণ নীতি কৌশল প্রণয়ন করা হচ্ছে।
এই কমিটির কাজ হলো দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সরকারকে সুপরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেয়া। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই কমিটি করার ফলে ব্যবসায়ীরা আরও সহজে তাদের যে কোন সমস্যা নিয়ে সরকারের কাছে আসতে পারবে। সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানের পথ তৈরি হলো বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে।
পরিবর্তনশীল বিশ্ব বাণিজ্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে দেশের উৎপাদক ও রফতানিকারকদের। ফলে তাদের অধিক শক্তি ও প্রতিযোগিতার সামর্থ্য অর্জনে বাণিজ্য সম্প্রসারণ নীতিপ্রণয়ন করা হচ্ছে। ওই কৌশলপত্রে বাণিজ্য সম্প্রসারণে আগামী ৫ বছর মেয়াদী ক্রাশ প্রোগ্রাম নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া বাণিজ্য সম্প্রসারণ নীতি কৌশল ধারণাপত্রে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে ১৩টি খাতের জন্য বিশেষভাবে সুপারিশ করা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়েছে-আন্তঃবাণিজ্য সম্প্রসারণ ছাড়াও দেশের রফতানিমুখী শিল্প-প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি, কারখানার উৎপাদন পরিবেশ ও কমপ্লায়েন্স বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া, পণ্যের গুণগতমান উন্নয়ন, পণ্য ও তার বাজার বহুমুখীকরণের প্রচেষ্টা জোরদার করার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া শ্রমনির্ভর রফতানি শিল্প স্থাপনে উৎসাহিতকরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের নগদ সহায়তা প্রদান, পশ্চাৎ অগ্রসংযোগ শিল্প গড়ে তোলায় উৎসাহিত করা, রফতানি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন পরীক্ষাগার স্থাপন, দক্ষতা বাড়াতে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, রফতানি বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের নগদ সহায়তা প্রদান, পণ্যভিত্তিক শিল্প এলাকা গড়ে তোলা, রফতানি পণ্যের কাঁচামাল সহজকরণ, বাজার ও প্রযুক্তি সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য উদ্যোক্তাদের সরবরাহ, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরকে সামগ্রিক উন্নয়ন ও পণ্য খালাস পদ্ধতি আরও সহজীকরণের উদ্যোগের প্রয়োজন বলে নীতিমালায় বলা হয়েছে।
জানা গেছে, পণ্য রফতানিতে জিএসপি সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকার বাংলাদেশ এ্যাকশন প্ল্যানের জবাব যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র সরকার জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে না দিলে সরকার কী পদক্ষেপ নিতে পারে-এ বিষয়ে পরামর্শ চাওয়া হবে। দেশের শ্রমমান উন্নয়ন এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে সরকারের কী ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন তা নিয়ে আলোচনা করা হবে ওই সভায়। এছাড়া উৎপাদনমুখী শিল্পে বিনিয়োগ, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং গ্যাস-বিদ্যুত সঙ্কট সমাধানে ৫ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।
বাণিজ্যসংক্রান্ত আইন মেনে চলতে হবে ॥ অর্থ-বাণিজ্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ইতোপূর্বে গ্রহণ করা সব সিদ্ধান্ত ও তাদের করা আইনগুলো সরকার কার্যকর করবে। সরকারের ধারাবাহিকতা থাকায় বাস্তবায়ন করা হবে- গ্রামীণ ব্যাংক আইন, মাল্টি লেভেল মার্কেটিং এমএলএম আইন, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ও নতুন কোম্পানি আইন। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে হরতাল-অবরোধ বন্ধে আইন করার চিন্তা-ভাবনা করছে নতুন সরকার। এ আইনটি প্রণয়ন ও তা কার্যকরের জন্য ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও তাদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের চাপ রয়েছে। বাণিজ্য বিষয়ক এই পাঁচটি আইন নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ করলেও গ্রামীণ ব্যাংক আইন-২০১৩ প্রণয়ন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে এই আইনটি করার আগে সরকার গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন গঠন করে। ওই কমিশনের মতামতের ভিত্তিতে গ্রামীণ ব্যাংক আইন চূড়ান্ত করা হয়। গ্রামীণ ব্যাংক আইন সংসদে পাস হয়েছে। ওই আইনে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা সরকারের হাতে রাখা হয়েছে। আর এমডি নিয়োগ হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তে। ফলে গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন নতুন বিধিমালা তৈরির কাজ চলছে।