Published in Prothom Alo on Wednesday, 11 June 2014.
বাজেট ২০১৪–১৫
টাঙ্গাইল ব্যর্থ, তবু আরও ছয় জেলা বাজেট
ফখরুল ইসলাম
পরীক্ষামূলক জেলা বাজেট ‘টাঙ্গাইল’-এর কোনো সাফল্য নেই। দেশে প্রথমবারের মতো জেলা বাজেট চালুর কথা বলে চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ জেলার জন্য এক হাজার ৮৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। পরে ২৭ কোটি টাকা বাড়িয়ে করা হয় এক হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষ হতে আরও ২০ দিন বাকি৷
কিন্তু এই টাকা কোন খাতে কীভাবে খরচ হলো, সেই হিসাব জেলা প্রশাসনের কাছে নেই। এক বছরে জেলাটির নিজস্ব আয় কত, হিসাব নেই তারও। কার্যকর থাকলে সব হিসাবই থাকত জেলা পরিষদের কাছে। কিন্তু, দেশের সব জেলা পরিষদের মতো টাঙ্গাইল জেলা পরিষদও আছে নামকাওয়াস্তে। এ পরিষদও কিছুই জানে না। আগে যেসব কাজকর্ম করতে হতো, তাই করতে হচ্ছে জেলা প্রশাসনকে। জেলা বাজেট আমলেও কোনো পরিবর্তন নেই। অর্থাৎ, টাঙ্গাইলের জেলা বাজেট আছে শুধু নামেই।
টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবু সালেহ্ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন খাঁ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজেট বরাদ্দের মোট পরিমাণ ছাড়া আমরা কিছুই জানি না। কোন খাতে কত খরচ হয়েছে, তা-ও অজানা আমাদের।’
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গাজী মো. সাইফুজ্জামানেরও প্রায় একই মন্তব্য। জেলার সারা বছরের ব্যয়ের হিসাব জানলেও এ ব্যয়ের প্রক্রিয়া জানে না জেলা পরিষদ।
তা সত্ত্বেও আগামী অর্থবছরের জন্য আরও ছয়টি জেলা বাজেটের ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য ঢাকা বিভাগ থেকে এবারও নেওয়া হয় টাঙ্গাইল জেলাকে। বাকিগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, রংপুর ও সিলেট জেলা। এগুলো বিভাগীয় সদর জেলা।
একটি জেলা এক বছরে কোন কোন উৎস থেকে কত টাকা আয় করবে এবং কোন কোন খাতে তা ব্যয় করবে, তার একটি চিত্র থাকে জেলা বাজেটে। কোনো জেলা প্রয়োজনের তুলনায় অর্থ ঘাটতিতে থাকলে কেন্দ্রীয় সরকার ওই জেলাকে কত টাকা দেবে, তারও হিসাব থাকে। প্রস্তাবিত জেলাগুলোর ক্ষেত্রে এসবের কিছুই নেই। অর্থাৎ পুরো অর্থই বরাদ্দ হবে কেন্দ্রীয়ভাবে৷
সাত জেলার জন্য এবার বাজেট বরাদ্দের একটি পুস্তিকা বের করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। এর মুখবন্ধে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আঞ্চলিক সমতা নিশ্চিত করতে জেলা বাজেট সহায়ক হবে বলে তাঁর বিশ্বাস। আর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হলে নতুন মাত্রা পাবে এই জেলা বাজেট। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমি সেদিনের স্বপ্ন দেখি, যখন জাতীয় বাজেট শুধু কেন্দ্রীয়ভাবেই প্রণীত বাজেটই-ই হবে না বরং এটি হবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের চাহিদার প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিফলন।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় সরকারকে দুর্বল রেখে জেলা বাজেটের বাস্তবায়ন অসম্ভব। টাঙ্গাইলের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আবার, সরকারের ভেতরেও জেলা বাজেটের ব্যাপারে রয়েছে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলা পরিষদকে কার্যকর না করে জেলা বাজেট ঘোষণা লোক দেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়।’ জেলা পরিষদের অস্তিত্বই নেই যেখানে, সেখানে কিসের জেলা বাজেট?—প্রশ্ন রাখেন তোফায়েল আহমেদ। তিনি আরও বলেন, কার কাছে দেওয়া হয়েছে এ বাজেট এবং ধারণই বা কে করছে? এসব প্রশ্নেরও জবাব মিলবে না৷
আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু নেপালে পুরোপুরি জেলা বাজেট রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রকৃত অর্থে জেলা বাজেট বলতে যা বোঝায়, তা প্রণয়ন করতে বড় ধরনের প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন। দেশের বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামোয় জেলা বাজেট প্রণয়ন সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় বাজেট থেকে জেলার জন্য দেওয়া বরাদ্দের একটি হিসাব প্রণয়ন শুধু সম্ভব।
বাস্তবে তাই হয়েছে। টাঙ্গাইলের জন্য পরীক্ষামূলক জেলা বাজেট চালুর ঘোষণার পর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গতবার বলেছিলেন, ‘এটাকে জেলা বাজেট মনে হয়নি। এটি হতে পারে টাঙ্গাইল জেলার ব্যয়ের একটি খতিয়ান।’ আর ৬ জুন সিপিডির বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের টাকা দিয়ে জেলা বাজেট করার কোনো মানে নেই। জেলাগুলোকে নিজস্ব আয় থেকে ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা অর্জনে মনোযোগ দিতে হবে।
জেলা বাজেট নিয়ে সব সময়ই কথা বলে আসছে আরেক বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র)। এবারের জেলা বাজেট প্রসঙ্গে সুপ্রর সমন্বয়কারী শরীফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে চাই বাজেট কাঠামোতে প্রক্রিয়াগত সংস্কার। নইলে জেলা বাজেটে ব্যয়ের খতিয়ানই থাকবে, মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নয়।’
{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়কা করেছেন প্রথম আলোর টাঙ্গাইল প্রতিনিধি কামনাশীষ শেখর}
সাত জেলার বাজেট বরাদ্দ
(২০১৪–১৫; কোটি টাকায়)
জেলা মোট বরাদ্দ উন্নয়ন ব্যয়
চট্টগ্রাম ৫,৬৮২.৭৪ ২,৫৮০, খুলনা ৩,২৯২.৯৪ ২,০০০, রাজশাহী ২,১৫০ ৫৯৫, বরিশাল ২,১০৬ ৭৭৯, সিলেট ২,১৭৫ ৮৭৩, রংপুর ২,০০৮ ৭২৫, টাঙ্গাইল ২,২৩৫ ৯০৬, এই টাকা কোন খাতে কীভাবে খরচ হলো, সেই হিসাব টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনের কাছে নেই