Published in Alokito Bangladesh on Tuesday, 28 July 2015.
উপেক্ষিত গ্রাম : শহরে বাড়ছে ভাসমান লোকের সংখ্যা
আঞ্চলিক দারিদ্র্যে সাফল্য ম্লান
জাহিদুল ইসলাম
এক দশক ধরে মোট দেশজ আয়ে (জিডিপি) প্রায় ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবু আঞ্চলিক দারিদ্র্যের হার বাড়ছে; পাশাপাশি শহরে বাড়ছে ভাসমান মানুষের হার। এর ফলে শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুতের ব্যবহারসহ নাগরিক সেবা প্রাপ্তির দিক থেকেও পিছিয়ে পড়ছে গ্রামের মানুষ। অর্থনীতিবিদদের মতে, বন্যা, খরা, নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সরকারি বিনিয়োগে বৈষম্যের কারণে দেশের বেশকিছু এলাকা অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে পড়ছে। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে না পেরে এসব এলাকার মানুষ শহরে ছুটছে; ম্লান হচ্ছে প্রবৃদ্ধির সাফল্য।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসেবে জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় দেশের সাড়ে ৩১ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। শহরাঞ্চলে এ হার ২১ দশমিক ৩ শতাংশ হলেও গ্রামে ৩৫ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে রংপুর, বরিশাল ও রাজশাহী অন্যতম। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুতের ব্যবহারসহ নাগরিক সেবা প্রাপ্তির দিক থেকেও পিছিয়ে রয়েছে গ্রামের মানুষ।
দেশের সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ বাস করে রংপুর বিভাগে। এ হার ৪৬ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম সবচেয়ে দরিদ্র জেলা। এর হার ৬৩ দশিমিক ৭ শতাংশ। এর পর আছে বরিশাল বিভাগ। এর হার ৩৯ দশমিক ২ শতাংশ। তৃতীয় দরিদ্র বিভাগ রাজশাহী। এর হার ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর চলতি মাসে প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম শীর্ষক এক জরিপে বলা হয়েছে, গেল এক বছরে প্রতি হাজারে ৭০ জনের বেশি মানুষ শহরে এসেছে। আর পরিসংখ্যান ব্যুরোর বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোক গণনায় বলা হয়েছে, বর্তমানে সারা দেশে বস্তিতে বসবাস করছেন ২২ লাখ ২৭ হাজার ৭৫৪ মানুষ, যা ১৯৯৭ সালে ছিল ৭ লাখ ৯ হাজার ৬৭৫ জন। এ হিসাবে ১৮ বছরে শহরে বস্তিতে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণের বেশি।
ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোর দিকে স্রোতের মতো ছুটছে গ্রামের মানুষ। এ সময় বরিশালের প্রায় ৪ শতাংশ মানুষ শহরে এসেছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগ থেকে ৫ শতাংশ ও খুলনা বিভাগ থেকে এসেছে সাড়ে ৫ শতাংশ মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনসংখ্যার ভারে ক্রমেই বসবাসের অনুপযোগী হচ্ছে ঢাকা মহানগরী। প্রতিদিন ঢাকাবাসীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে যানজট। নতুন মানুষের উপযোগী আবাসন ব্যবস্থাও গড়ে উঠছে না। ফলে বিপুল পরিমাণ মানুষের ঠিকানা হচ্ছে বস্তিতে। বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোক গণনার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে বস্তিতে বসবাস করা মানুষের অর্ধেক রয়েছেন ঢাকা মহানগরীতে। রাজধানীতে বর্তমানে বস্তিবাসীর সংখ্যা ১০ লাখ ৬১ হাজার ৬৯৯। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ থাকেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন বস্তিতে। এর বাইরে দেশে আরও ঠিকানাহীন ১৬ হাজার ৬২১ জন ভাসমান মানুষ রয়েছে।
দেশের শিল্পায়নও সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে ঢাকাকেন্দ্রিক। অর্থনৈতিক শুমারির তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে বর্তমানে ২৫ লাখ ৯৯ হাজার শিল্প ইউনিট রয়েছে। সারা দেশে শিল্প ইউনিট আছে প্রায় ৮০ লাখ ৭৫ হাজার। এ হিসাবে ৩২ ভাগের বেশি শিল্প ইউনিট স্থাপিত হয়েছে ঢাকায়। ১০ বছরে ঢাকায় শিল্প ইউনিট বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। এর বাইরে চট্টগ্রামে ১৩ লাখ ৮৫ হাজার, রাজশাহীতে ১২ লাখ ১৮ হাজার, খুলনায় ১০ লাখ ৩৪ হাজার শিল্প ইউনিট রয়েছে।
অঞ্চলভিত্তিক দারিদ্র্য নিরসন ও সম্পদের আঞ্চলিক অসমতা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বেশকিছু পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি উন্নয়নে প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। হাওর অঞ্চলের বন্যা ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে নেয়া হচ্ছে ৯৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকার একটি প্রকল্প। উত্তরাঞ্চলের দরিদ্রদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে ৯৪ কোটি ৮৭ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকায় নেয়া হয়েছে অপর একটি প্রকল্প। কৃষিপ্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে অর্থনীতির গতি আনার লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৭৩ কোটি টাকা। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আঞ্চলিক দারিদ্র্য কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, আঞ্চলিক দারিদ্র্য নিরসনে সরকার কাজ করছে। বেশ কয়েকটি অঞ্চলের উন্নয়নে প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। তাছাড়া যে কোনো প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক দারিদ্র্য অবসানের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে কমে আসবে আঞ্চলিক দারিদ্র্যের হার।
মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আঞ্চলিক দারিদ্র্য বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। একই কারণে নগর এলাকায় মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বলে তাদের ধারণা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও অবকাঠামো সঙ্কটের কারণে কিছু এলাকার লোকজন পিছিয়ে পড়ছে। কয়েক বছর ধরে জাতীয় আয়ে মোটামুটি প্রবৃদ্ধি হলেও দরিদ্র জনগোষ্ঠী আনুপাতিক হারে এর সুফল পাচ্ছে না। সম্পদের বৈষম্য কমাতে নেয়া সরকার ও বেসরকারি পর্যায়ের প্রকল্পগুলোর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তিনি বলেন, আঞ্চলিক দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে নেয়া প্রকল্পগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এ বিষয়ে সৃজনশীল নতুন কিছু করতে হবে। সম্পদের সীমাবদ্ধতার কথা বলে বৈষম্য কমাতে সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন-সহযোগীদেরও দায়িত্ব রয়েছে। পাইপলাইনে আটকে থাকা বিদেশি সহায়তাও এক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের তৈরি করা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় আয়ের মাত্র ৫ দশমিক ২২ শতাংশের মালিক সবচেয়ে দরিদ্র, ২০ শতাংশ মানুষ। ২০০৫ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। ১৯৯২ সালে ২০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের আয় ছিল জিডিপির ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। সম্পদে দরিদ্র মানুষের অংশীদারিত্ব কমে আসায় উদ্বেগ প্রকাশ করাছেন সংশ্লিষ্টরা।
আঞ্চলিক দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশের দারিদ্র্য মানচিত্রে চরমভাবে ফুটে উঠেছে। বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রণীত এ মানচিত্রে বলা হয়েছে, দেশে গড় দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশ হলেও রংপুর বিভাগে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪৬ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া বরিশাল বিভাগে ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র।