Published in Amader Shomoy on Thursday, 5 February 2015.
কোমর ভাঙছে অর্থনীতির
রুমানা রাখি
গত এক মাসের টানা অবরোধ আর মাঝে-মাঝে হরতালে দেশের সার্বিক অর্থনীতি ধুঁকছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের এমন কোনো খাত নেই যেখানে রাজনৈতিক এ কর্মসূচির ক্ষতিকর প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়েনি। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর দেওয়া একদিনের হরতাল-অবরোধে ক্ষয়ক্ষতির অঙ্ক হিসাব করলে গত ৩১ দিনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ অঙ্ক সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এক অর্থবছরে ব্যয় করা অর্থের প্রায় সমান। আর ২০১৪-১৫ সালে ঘোষিত ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার জাতীয় বাজেটের প্রায় ২৮ শতাংশ।
এদিকে টানা অবরোধে দেশের অর্থনীতির কোমর ভাঙছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, গত এক মাসের অবরোধ-হরতালে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। কারণ ব্যবসায়ীরা কেবল নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির অংকই হিসাব করেছেন। কিন্তু এ রাজনৈতিক অস্থিরতায় যে দেশের অন্যান্য পেশাজীবী কর্মহীন হয়ে পড়ছেন, উন্নয়ন কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়ছেÑ সে কথা বলছেন না। অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজনৈতিক পরিবেশ স্বাভাবিক হলেও গত এক মাসের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এক বছরেরও বেশি সময় লাগবে। আর ২০১৩ সালের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতার ক্ষত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে নতুন এ ক্ষত ভোগাবে দেশের অর্থনীতিকে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, চলমান অবস্থার অবসান না হলে ক্ষতির মাত্রা দিনদিন বাড়বে, যা আমাদের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। তাই যে কোনোভাবে চলমান অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে।
ব্যবসায়ীদের মতে, বিচ্ছিন্ন হরতাল-অবরোধে একদিনে লোকসানের পরিমাণ কম হয়। কারণ সপ্তাহের বাকি দিনগুলোয় বাড়তি উৎপাদন ও অধিক বিপণনের মধ্য দিয়ে সেই লোকসান পুষিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু এবার একমাস ধরে টানা হরতাল-অবরোধে ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। সার্বিক পরিস্থিতিতে আজ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে জনজীবনও বিপর্যস্ত। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে রাজনীতিবিদদের দ্রুত চলমান সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানান ব্যবসায়ীদের।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) তথ্যমতে, একদিনের হরতাল বা অবরোধে ক্ষতি হয় ২ হাজার ২৭৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। সে হিসাবে গত ৩১ দিনের হরতাল-অবরোধে অর্থনীতিতে ৭০ হাজার ৭১০ কোটি ৫৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পে ২৬ হাজার ১১৭ কোটি ৫ লাখ, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৯ হাজার ৩০০ কোটি এবং কৃষি খাতে ৮ হাজার ৯২৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আবাসন ও পর্যটন খাতে ক্ষতি হয়েছে যথাক্রমে ৭ হাজার ৭৫০ কোটি ও ৬ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। আর উৎপাদন খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১৯৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এছাড়া পাইকারি বাজার, শপিংমল, শোরুম, মুদিদোকানের ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। স্থলবন্দর ও বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল আদায়ে ক্ষতির অঙ্ক ১ হাজার ২৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। সিরামিক ও পোলট্রি খাতে যথাক্রমে ৬২০ কোটি এবং ২৯২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। প্লাস্টিকদ্রব্য প্রস্তুত ও রপ্তানিতে ৫৫৩ কোটি ৩৫ লাখ, বিমা খাতে ৪৬৫ কোটি, হিমায়িত খাদ্য খাতে ২৪৮ কোটি এবং হকার্স খাতে ৫৬০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়।
ডিসিসিআই সভাপতি হোসেন খালেদ বলেন, স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল একটি গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাধ্যমে জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে সকলের শাসনতান্ত্রিক অধিকার সমুন্নত রাখা। তাই যে কোনো রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হলে রাজনৈতিক দলগুলোকেই কার্যকর আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে হবে, যেন রাজনীতির কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
চলমান অবরোধ-হরতালে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা। এরই মধ্যে এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ ২৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, যা প্রতিদিনই বাড়ছে। তৈরি পোশাকের ক্রয় আদেশ বাতিল, মূল্যছাড়, উড়োজাহাজে পণ্য পাঠানো, জাহাজিকরণে বিলম্ব ও নাশকতার কবলে পড়ে এসব ক্ষতি হয়েছে বলে জানায় তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)। গত ১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিজিএমইএতে ক্ষতির এই হিসাব পাঠিয়েছে ২৩টি সদস্য কারখানা।
বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা নিরাপদে ব্যবসা করতে চাইÑ এ দাবি নিয়ে আমরা মানববন্ধনও করেছি। কিন্তু কেউ গা করেননি। এখন আমরা তাকিয়ে আছি, যাদের দায়িত্ব আমাদের নিরাপত্তা দেওয়া বা অর্থনীতিকে রক্ষা করে কর্মসূচি দেওয়া, তাদের দিকে। এফবিসিসিআইয়ের দেওয়া কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করবে বিজিএমইএ।
বিজিএমইএর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলমান হরতাল-অবরোধে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর ৯২ লাখ ৯২ হাজার ২৩৬ ডলারের ক্রয় আদেশ বাতিল হয়েছে। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে মূল্যছাড় দেওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৫ লাখ ১৫ হাজার ৭৩৩ ডলার। উড়োজাহাজে পণ্য পাঠাতে বাড়তি খরচ হয়েছে ৭ লাখ ৮২ হাজার ৯৬৫ ডলার। নাশকতায় ক্ষয়ক্ষতি ৩৯ লাখ ৩৬ হাজার ১৪৩ ডলার। পণ্য জাহাজিকরণে বিলম্ব বা আটকে আছে ৪৪ লাখ ৯২ হাজার ২২১ ডলারের পণ্য।
এদিকে গত ৩১ দিনে বীমা খাতে ৪৬৫ কোটি ক্ষতি হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ)। বিআইএ সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ২০১৩ সালে ১ হাজার কোটি টাকার সম্পদের বিমা দাবি এসেছে। এ বিষয়ে বিআইএ সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, হরতাল-অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির বিমা দাবি পেতে অবশ্যই এর জন্য কাভারেজ নিতে হবে। এজন্য আলাদা প্রিমিয়ামও পরিশোধ করতে হবে। হরতাল-অবরোধের বিমা কাভারেজ নেওয়া নেই, এমন কোনো গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিমা দাবি পাবে নাÑ এমন উদ্যোগ নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা কোনো কিছুতে জোর করতে পারি না।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা সমুন্নত রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি দিতে হবে। হরতাল সাধারণ নাগরিক জীবন, উৎপাদন ব্যবস্থা, পণ্য সরবরাহসহ দৈনন্দিন কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত করে। পাশাপাশি হরতালে দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বিঘিœত হয়। তাই এবার এ ধরনের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি বন্ধের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো।
গত এক মাসে হরতাল-অবরোধে প্লাস্টিক খাতে প্রায় ৪৬৫ কোটি টাকা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সভাপতি জসিম। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় কাঁচামাল ঘাটতিসহ নানা কারণে উৎপাদন বন্ধ। অন্যদিকে বিশেষ করে বিদেশি ক্রেতারা মনে করছেন, উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো আমরা পণ্য সরবরাহ করতে পারব না। তাই আমাদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন তারা।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এমএ খান বলেন, ৩১ দিনের হরতাল-অবরোধে এ খাতে ৬৮২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বার্ড ফ্লুর কারণে একবার এ খাতে ধস নামে। সে অবস্থা কাটিয়ে উঠলেও চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ফের বিপদে পড়েছেন খামারিরা। অবরোধে পরিবহন সমস্যার কারণে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ডিম ও মুরগি অবিক্রীত থাকছে। খাদ্য সরবরাহ না থাকায় প্রতি সপ্তাহে অবিক্রীত প্রায় ২২ লাখ মুরগির বাচ্চা মেরে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন উৎপাদনকারীরা।
এদিকে টানা অবরোধে দেশের পরিবহন খাত বিপর্যস্ত এবং এ খাত সংশ্লিষ্টদের প্রায় অর্ধেক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি বলেন, অবরোধের কারণে গাড়ি বন্ধ থাকায় ২০ লাখ পরিবহন শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ বর্তমানে কর্মহীন। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অস্তিত্ব থাকবে না।
পরিবহন মালিক সমিতির হিসাবমতে, গত ৫ জানুয়ারি থেকে ২০-দলীয় জোটের চলে আসা অবরোধে পরিবহন খাতে ক্ষতি হয়েছে ৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত নাশকতাকারীদের আগুন ও পেট্রলবোমায় পুড়েছে অন্তত ৪৫০টি গাড়ি। এছাড়া অবরোধ সমর্থকরা ভাঙচুর করে প্রায় ৮০০টি যানবাহন।
সিপিডির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩-এর জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ৫৫ দিন হরতাল-অবরোধ হয়। ওই সময় রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতি হয় ৪৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে ওই সময় একদিনের হরতালে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় পরিবহন খাতে, ৩০৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল কৃষি। এ খাতের একদিনের ক্ষতি হয় ২৮৮ কোটি টাকা। বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে ক্ষতির পরিমাণ ২৫০ কোটি আর পর্যটন খাতে ৫০ কোটি টাকা। গত বছর ৩ আগস্ট প্রকাশিত ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়, হরতালের কারণে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের প্রায় ৫৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকার (৭০০ কোটি ডলার) ক্ষতি হয়েছে।