Published in Prothom Alo on Friday, 28 August 2015.
বেড়েছে গ্যাসেরও
উৎপাদন খরচ কমলেও দাম বাড়ল বিদ্যুতের
বিশেষ প্রতিনিধি
উৎপাদন খরচ কমলেও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল সরকার। বিশেষজ্ঞরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্তকে ‘অযৌক্তিক’ বলে মনে করছেন। বিদ্যুতের পাশাপাশি গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গতকাল বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর কথা ঘোষণা করে। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে এ বাড়তি দাম কার্যকর হবে।
এবার প্রতি ইউনিট (এক কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে গড়ে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে কম বিদ্যুৎ (৫০ ইউনিটের নিচে) ব্যবহারকারী বা লাইফলাইন গ্রাহক এবং সেচ ও সার কারখানায় ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। তবে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে লাইফলাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম আগের মতোই এবারও বেশি রাখা হয়েছে। ফলে গ্রাম ও শহরের দরিদ্র গ্রাহকদের মধ্যে বৈষম্য রয়েই গেছে।
পাশাপাশি গড়ে প্রতি ইউনিট (এক হাজার ঘনফুট) গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। এর আগে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে সব গ্রাহক শ্রেণির গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। আর গত পাঁচ বছরে পাইকারি ও ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ছয়বার করে। এর আগে গত বছরের ১৩ মার্চ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়, যা কার্যকর হয়েছিল ওই বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে।
গ্রাহকস্বার্থ সংরক্ষণে কর্মরত কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে গণবিরোধী বলেছেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ম. তামিম একে অযৌক্তিক বলে অভিহিত করেছেন। আর সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, রপ্তানি আয়ে মন্দা ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় এই সময় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো অর্থনীতি ও জনজীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
তবে গতকাল বিকেলে কারওয়ান বাজারের টিসিবি ভবনের বিইআরসি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে বিইআরসির চেয়ারম্যান এ আর খান দাবি করেন, তাঁরা গ্রাহকস্বার্থের অভিভাবক। গ্রাহকদের স্বার্থেই তাঁরা দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দাম বাড়ানো না হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হবে, যা গ্রাহকস্বার্থের অনুকূল হবে না।
এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়েছে, দাম না বাড়ালে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর আয় কমবে এবং তারা সরবরাহ ব্যবস্থাপনা খাতে বিনিয়োগ করতে পারবে না। তাতে সরবরাহ বিঘ্নিত হয়ে গ্রহকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সূত্র জানায়, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় দেশে তেলচালিত কেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ১০ টাকার মধ্যে। বেসরকারি খাতের যে কোম্পানিগুলো সরকারের অনুমোদন নিয়ে নিজেরাই তেল (ফার্নেস) আমদানি করছে, পিডিবি তাদের কাছ থেকে প্রতি ইউনিট ১০ টাকা করেই প্রতিদিন প্রায় ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছে।
অপরদিকে, দেশে তেলের দাম না কমানোয় সরকার নির্ধারিত দামে বিপিসির তেল নিয়ে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চলছে, তাদের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ১৬ থেকে ১৭ টাকা। এ দামে কেনা বিদ্যুতের পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট। ফার্নেস তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হলে এই দেড় হাজার মেগাওয়াটও প্রতি ইউনিট ১০ টাকা দামে পাওয়া যেত। ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দরকার হতো না। বরং জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম কম থাকলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ত।
বিনিয়োগবিরোধী, অযৌক্তিক ও গণবিরোধী
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিইআরসির চেয়ারম্যান গতকাল সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা তাঁদের দায়িত্ব নয়। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো গত বছর দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাব দিয়েছিল, তার ভিত্তিতেই তাঁরা দাম বাড়িয়েছেন।
সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিইআরসির চেয়ারম্যান এ আর খান ও সদস্য সেলিম মাহমুদ বলেন, এবারের দাম বাড়ানোর পরও বিদ্যুৎ খাতে চলতি অর্থবছরে সরকারকে ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। আর বর্ধিত দাম থেকে বিতরণ কোম্পানিগুলো মুনাফা করতে পারবে না। তারা ‘না লাভ, না ক্ষতি’র পর্যায়ে থাকবে। বাড়তি অর্থ যাবে সরকারি কোষাগারে, যা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করা হবে। এসব বিষয় স্পষ্ট করে একটি পূর্ণাঙ্গ আদেশ তাঁরা তৈরি করছেন। কয়েক দিনের মধ্যে তা গণমাধ্যমকে দেওয়া হবে।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি। সবচেয়ে বেশি বাড়ানো হয়েছে ‘ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ’ উৎপাদনে (শিল্পকারখানায় নিজস্ব জেনারেটরে নিজেদের ব্যবহারের জন্য কম দামে গ্যাস নিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ)। এ ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটের দাম হবে ৮ টাকা ৩৬ পয়সা, যা আগে ছিল ৪ টাকা ১৮ পয়সা।
কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাসের (সিএনজি) দাম প্রতি ইউনিট ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করা হয়েছে। এ দাম থেকে সিএনজি স্টেশনের মালিকেরা আগে পেতেন সাত টাকা। এখন পাবেন আট টাকা। গৃহস্থালি গ্রাহকদের মধ্যে যাঁদের মিটার আছে, তাঁদের প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য আগের ৫ টাকা ১৬ পয়সার স্থলে দিতে হবে সাত টাকা। এক চুলার গ্রাহকদের ৪০০ টাকার পরিবর্তে ৬০০ এবং দুই চুলার গ্রাহকদের ৪৫০ টাকার পরিবর্তে ৬৫০ টাকা দিতে হবে আগামী মাস থেকে। এ ছাড়া শিল্প, চা-বাগান ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের ক্ষেত্রেও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে।
বর্ধিত দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট গ্যাসের সম্পদমূল্য ধরা হয়েছে ২৫ টাকা। আগে গ্যাসের কোনো মূল্য ধরা ছিল না। দাম নির্ধারণ করা হতো শুধু উত্তোলন ও সরবরাহ ব্যয়ের ভিত্তিতে। তার ওপর ভর্তুকি দেওয়া হতো। গ্যাস খাতে এখন কত ভর্তুকি লাগবে, তা বিইআরসির পূর্ণাঙ্গ আদেশে জানা যাবে।
গতকালের সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিইআরসির সদস্য মো. দেলোয়ার হোসেন, মো. মাকসুদুল হক এবং রহমান মুরশেদ উপস্থিত ছিলেন।
Published in Ittefaq
বিদ্যুৎ-গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক
অভিমত বিশেষজ্ঞদের
দেশে একইসঙ্গে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে ২০০৯ সালের পর জ্বালানি তেলের মূল্য এখন সর্বনিম্ন। দেশের বাজারে তেলের মূল্য না কমিয়ে সরকার দীর্ঘদিন ধরে মুনাফা করছে। আবার তেলের দাম কমায় বিদ্যুতের উত্পাদন খরচও কমেছে। বর্তমানে বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট উত্পাদন ও খুচরা মূল্যের মধ্যে তফাত প্রায় দেড় টাকা। বিদ্যুতে ভর্তুকিও কমছে। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম গড়ে ২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং বিদ্যুতের দাম ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বাড়ানোর মাধ্যমে জনগণ ও শিল্পের উপর খরচের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেয়া হল। বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও জ্বালানি পরিস্থিতিতে এ মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক ও ‘উল্টো দিকে যাত্রা’ বলে তারা মত দিয়েছেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পেট্রোলিয়াম প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, কোন যুক্তিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। দেশে সাতটি কোম্পানি ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য কম দামে তেল ব্যবহার করায় বিদ্যুতের গড় উত্পাদন মূল্য প্রায় ৫০ পয়সা কমে সাড়ে ছয় টাকা থেকে ছয় টাকার কাছাকাছি হয়েছে। সব মিলিয়ে তেলচালিত বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্রগুলোতে প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদিত হচ্ছে। দেশে তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী নির্ধারণ করা হলে বিদ্যুতের গড় উত্পাদন মূল্য সাড়ে পাঁচ টাকার কাছাকাছি চলে আসত। এর ফলে বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে মানুষকে সুবিধা দিতে পারত সরকার। একইসাথে শিল্প-উত্পাদনেও উত্সাহ দিতে পারত। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে বিপরীত প্রতিক্রিয়াই দেখিয়েছে সরকার।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বিদ্যমান জ্বালানি পরিস্থিতিতে সরকার জনগণকে সুবিধা দেয়ার পরিবর্তে অসুবিধা তৈরি করেছে। গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) গণশুনানিতে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর পক্ষে জোরালো কোনো যুক্তি পাওয়া যায়নি। বরং বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে এবং কমার প্রবণতা অব্যাহত থাকবে বলেই পূর্বাভাস মিলেছে। তাই দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুতের দাম অপরিবর্তিত থাকার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি জনগণের স্বার্থবিরোধী।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বি ডি রহমত উল্লাহ বলেন, এবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে উল্টোপথে হেঁটেছে সরকার। বাড়তি আয়ের মাধ্যমে বিদ্যুত্খাতের উন্নয়ন করা হবে বলা হলেও তার পন্থা সঠিক নয়। নতুন করে পর্যালোচনা না করে দাম বাড়ানোর ঘোষণা যৌক্তিক নয়। আর গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম একসাথে বাড়িয়ে মানুষের দিকে অহেতুক আর্থিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে।
‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ’র বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, জ্বালানি খাতের ভর্তুকি ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারকে এখন সুনির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, দেশের বিনিয়োগ ও রপ্তানি পরিস্থিতি এখন ভালো নয়। এ অবস্থায় গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি নতুন বিনিয়োগকেও নিরুত্সাহিত করবে। নতুন করে মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের সামর্থ্য বিবেচনায় না নিয়ে শুধু রাজস্ব আয়ের প্রতি নজর দেয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান এ আর খান বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের বর্ধিত মূল্যহার যৌক্তিক। গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষা করেই নতুন মূল্যহার ঘোষণা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার দেশে ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য আবারো বাড়িয়েছে সরকার। বর্ধিত এই মূল্যহার আগামী এক সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হবে।