Published in Dinkal on Monday, 31 August 2015.
সরকারের দুর্নীতির বোঝা জনগণের কাঁধে
মোস্তাফিজুর রহমান বিপ্লব
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমায় বিদ্যুৎ-গ্যাস উৎপাদন খরচও কমে আসার পরও বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর সরকারি সিদ্ধান্তকে ‘অযৌক্তিক’ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, এতে দেশের শিল্প বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় বেড়ে যাবে। সরকারের দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি, ব্যাংক, পদ্মা সেতু ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি আর মেগা প্রকল্পের লুটপাটের বোঝা সাধারণ মানুষের কাঁধে চাপাতে হঠাৎ এই মূল্যবৃদ্ধি করেছে। তারা অবিলম্বে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে তেলের দাম কমানোর দাবি করে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান। এদিকে সরকারের গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণার পরই গণপরিবহনসহ জ্বালানি সংশ্লিষ্ট সকল দ্রব্যের মূল্যই লাফিয়ে বাড়তে শুরু করায় জনজীবনে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা রয়েছে। যেহেতু বিশ্ববাজারে তেলের দাম এখন কম, সুতরাং এই সময়ে হুট করে এমন সিদ্ধান্তের যেমন যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ তেমনই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এমন সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার জন্য অনেকে চেষ্টা করবে সেটাও জনমনে বেশ বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলেই মন্তব্য অর্থনীতিবিদদের। গণশুনানি হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসে, খোঁজা হচ্ছিল গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা। কিন্তু তখন গণশুনানিতে এসবের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। ফলে সেই দফা দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেও এবার হঠাৎ করেই ঘোষণা দিয়ে গাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বিইআরসি। বিশ্ববাজারে এখন তেলের দাম কমতির দিকে, তার মানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন খরচের পরিমাণটাও হচ্ছে কম। এমন সময়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর এমন সিদ্ধান্তকে ‘অযৌক্তিক’ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ তেল-গ্যাস-বন্দর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, এর আগেও যখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল তখনও বলা হয়েছে, বাড়তি টাকা দিয়ে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল করা হবে। সেটারও কোনো খোঁজখবর কারো কাছে নেই। কার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সে টাকা, কতটা রয়েছে সেটাও জানা নেই কারো। শুনেছি সেই তহবিলে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে, তাহলে ওসব কেন ব্যবহৃত হচ্ছে না। আনু মুহাম্মদ বলেন, সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য, মানুষের আয় বেড়েছে, সুতরাং ব্যয় বাড়লে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। আদতে সেটা তো কোনো সমাধান নয়। আয় বেড়েছে বটে কিন্তু সেটা সবার নয়, গড় করে আয় বাড়ার হিসাব কখনোই সবার বাড়তি আয়কে নির্দেশ করে না। শুধু জনজীবনে নয় সার্বিকভাবে এই দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে সবদিকেই। আনু মুহাম্মদের মতে, এই সমস্যার সমাধান তো আর জনগণের হাতে নেই। এর সমাধান করতে পারবে একমাত্র সরকার। এসবই দেখতে হবে উপযোগিতার ভিত্তিতে। জাতীয় সংস্থাগুলোর বিকাশ ঘটাতে হবে, বৃদ্ধি করতে হবে জাতীয় মালিকানা। উল্টো চাপ বন্ধ না করলে আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের অর্থনীতি।
একই কথা বললেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি খন্দকার মোস্তাহিদুর রহমান। তিনি বললেন, গ্যাস তো আর বর্ডার হয়ে আমদানি-রফতানি করা হয় না। সুতরাং উৎপাদন খরচ তো আর বাড়ছে না। সেখানে যদি বাড়তি টাকা গ্রহণ করা হয় তাহলে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর কাজেই ব্যয় হওয়াই উচিত। গ্যাসের দাম বাড়লে বাড়বে জীবনযাত্রার মান। এর প্রভাব পড়বে সাধারণ জনগণের উপর। খন্দকার মোস্তাহিদুর রহমানের বক্তব্য, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে বেড়ে যাবে উৎপাদন খরচ। শিল্পপতিদের খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে বাড়বে সব জিনিসপত্রের দাম। এর ফলে স্বভাবতই অনেকাংশে কমে আসবে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ। সেটাও তো ক্ষতিই বয়ে আনবে পুরো দেশের উপর। সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি তৈরি হয় জনগণের উপর। তবে এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতেও। সেটা একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে না হলেও দীর্ঘমেয়াদে এই সমস্যায় পড়তেই হবে দেশকে। খন্দকার মোস্তাহিদুর রহমান বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত বিনিয়োগ বিরোধী। দীর্ঘমেয়াদি সুফল পেতে হলে এখন নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করা উচিত। তাহলেই দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাবে দেশ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এই মূল্যবৃদ্ধি সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াবে। কিন্তু বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। তাছাড়া বেসরকারি খাত প্রতিযোগিতায় নামতে অসুবিধা বোধ করবে। তার মতে, সরকার বরং জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে এবং বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে পারত। দেবপ্রিয় বলেন, সরকারের একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে, তা হলো জ্বালানি তেলের দামের ক্ষেত্রে সরকার কি বিদ্যমান ব্যবস্থায়ই থাকবে, নাকি বাজার ব্যবস্থায় যাবে। জ্বালানি খাতে শৃঙ্খলার জন্য এটা অপরিহার্য।
বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, আইএমএফ- বিশ্বব্যাংক এবং দেশি-বিদেশি এজেন্টদের খুশি করার জন্যই সরকার গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করেছে। তিনি বলেন, দাম বাড়ানোর সময় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। এরা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪ শতাংশ। বাকি ৯৬ শতাংশের আয় তো বাড়ছে না। তাই এই যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যাংক ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি আর প্রকল্পের লুটপাটের বোঝা সাধারণ মানুষের কাঁধে চাপাতে এই মূল্যবৃদ্ধি। এটা জনগণ মেনে নেবে না। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে তেলের দাম কমাতে হবে। তিনি বলেন, গত ৮ জানুয়ারি সিপিবি-বাসদ’র পক্ষ থেকে বিইআরসিকে চিঠি দিয়ে দাম কমানোর লক্ষ্যে গণশুনানির আয়োজনের অনুরোধ করা হয়েছিল। তারা তা না করে দাম বৃদ্ধির জন্য গণশুনানি করলেন। কিন্তু তারা ওই গণশুনানিতে দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি হাজির করতে পারলেন না।
গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার দেশের ১৬ কোটি মানুষকে ইলেকট্রিক শক দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বুদ্ধিজীবী ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ। গতকাল এক সভায় তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমেছে তাই দাম বাড়ানোর কোনো কারণ নেই। অযৌক্তিকভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার দেশের ১৬ কোটি মানুষকে ইলেকট্রিক শক দিয়েছে। তিনি সরকারকে আমলা, অসৎ ব্যবসায়ী-বান্ধব না হয়ে জনবান্ধব হওয়ার আহ্বান জানান।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ গোফরান ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন এক বিবৃতিতে বলেছেন, দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে জনগণের যখন নাকাল অবস্থা তখন গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি জনগণের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ যখন অনেক কমে এসেছে সেই মুহূর্তে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য না কমিয়ে বরং বৃদ্ধি করার উদ্যোগ সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী মনোভাবেরই পরিচায়ক। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।