Published in Prothom Alo on Friday, 3 July 2015.
সংবাদ বিশ্লেষণ
মর্যাদা বেড়েছে নিম্ন মধ্যম আয়ের বাংলাদেশের
শওকত হোসেন
এমন নয় যে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, আপনার পকেটে থাকা একমাত্র এক শ টাকার নোটটি রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অফিসে এসে বেতন বাড়ারও খবর পেলেন না। পরিবর্তনই হলো না কিছুই, সবই আগের মতো আছে। অথচ আপনি কিন্তু রাতারাতি নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের নাগরিক হয়ে গেছেন।
তাহলে বাংলাদেশের লাভটা কী হলো? তারাপদ রায়ের সেই কবিতা থেকে বলা যায়, ‘অসীম দয়ার শরীর আপনার/ আপনি এসে আমাকে বললেন,/ না, গরিব কথাটা খুব খারাপ/ ওতে মানুষের মর্যাদা হানি হয়।’ পার্থক্য এটাই। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এই নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদাই খানিকটা বেড়েছে। এর বাইরে অর্থনৈতিক লাভ আপাতত আর কিছু হয়নি।
কোন দেশ নিম্ন আয়ের, আর কোন কোন দেশ উচ্চ বা মধ্যম আয়ের, তা নির্ধারণ করে একমাত্র বিশ্বব্যাংক। মূলত কোন দেশগুলোকে তারা কী ধরনের ঋণ দেবে, সেটা ঠিক করতেই এই শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। বিশ্বব্যাংকের পরিমাপ অনুযায়ী, ১ হাজার ৪৫ ডলার থেকে ১২ হাজার ৭৩৫ ডলার পর্যন্ত মাথাপিছু জাতীয় আয় হলে একটি দেশ মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় ঢুকে পড়বে। তবে যেহেতু সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ আয়ের মধ্যে পার্থক্যটি অনেক বড়, তাই মধ্যম আয়কে আবার দুটি উপখাতে ভাগ করেছে বিশ্বব্যাংক। অনেকটা উচ্চ মধ্যবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্তের মতো। আর এই ভাগ অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় ঢুকেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় (জিএনআই) এখন ১ হাজার ৩১৪ ডলার। তবে বিশ্বব্যাংকের পরিমাপ পদ্ধতিতে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৮০ ডলার। অর্থাৎ সামান্য ওপরে আছে বাংলাদেশ। সুতরাং ঝুঁকিও আছে বাংলাদেশের। যেমন, গৃহযুদ্ধ ও জাতীয় তেল খনি নিয়ে বিপত্তির কারণে দক্ষিণ সুদান নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে নিচে নেমে নিম্ন আয়ের দেশে চলে গেছে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ফলে দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নত হবে। দেশের ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে এ অর্জন ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। কিন্তু তাতে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। এই অর্জনের ফলে এখন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়াও একটু কঠিন হতে পারে। কারণ, ঋণদাতারা এখন হয়তো কিছুটা কঠিন শর্ত জুড়ে দিতে পারে। তাই সরকারকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশ যেসব সুবিধা পেয়ে থাকে, সেগুলো যেন অব্যাহত থাকে, এ ব্যাপারেও সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।
বিশ্বব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মধ্যম আয়ের তালিকায় ঢুকলেও বাংলাদেশ সহজ শর্তের (আইডিএ) ঋণ পেতে থাকবে। যেমন এখন ৩৯ বছরে পরিশোধযোগ্য ঋণ পায় বাংলাদেশ। পরিশোধের জন্য বাড়তি আরও ৬ বছর দেওয়া হয়। আর সুদ দিতে হবে দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে। তবে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২০০ ডলার হলে এই ঋণ আর পাবে না। তখন ৫ শতাংশের বেশি সুদে ঋণ নিতে হবে। থাকবে না পরিশোধের দীর্ঘ সময়। মধ্যবিত্তরা যেমন হাত পাততে পারে না, মধ্যম আয়ের দেশ হলে বাংলাদেশও তা আর করতে পারবে না। সুতরাং এখন থেকেই সে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।
আয় বৃদ্ধিই উন্নয়ন নয়: মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে কেবল মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিকেই সূচক হিসেবে গণ্য করে বিশ্বব্যাংক। কেবল মাথাপিছু জাতীয় বৃদ্ধির প্রবণতা থেকে তারা এই তালিকা করে থাকে। আর কোনো সূচক বিবেচনা করা হয় না। অথচ প্রবৃদ্ধির সুফল গড়িয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে যাওয়ার তত্ত্ব বাতিল হয়ে গেছে সেই ষাটের দশকেই। সে সময়ে অর্থনীতিবিদেরা গবেষণা করে দেখান, অনেক দেশে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও এর সুফল দরিদ্র মানুষেরা পাননি। অনেক দেশে বৈষম্য বেড়েছে, অপূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থান বেড়েছে কৃষি খাতে এবং সাধারণ মানুষের জীবনমানেরও অবনতি ঘটেছে।
সত্তরের দশকেই অর্থনীতিবিদেরা এটা মেনে নেন যে কেবল মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি একটি দেশের উন্নয়নের সঠিক বা যথাযথ নির্দেশক নয়। এরপরই উন্নয়ন তত্ত্বে পুনর্বণ্টন এবং সামাজিক সূচক বিষয়টি গুরুত্ব পায়।
এলডিসি থেকে উত্তরণ: জাতিসংঘ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকের ভিত্তিতে বিশ্বের দেশগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করে। যেমন, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি), উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশ। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত বা এলডিসি। বর্তমানে এলডিসিতে আছে ৪৮টি দেশ। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত এলডিসি থেকে উত্তরণ। কারণ, এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য আয় বাড়ানোর পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়।
বিশ্বব্যাপী এখন নিম্ন আয়ের দেশের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। ১৯৯৪ সালে নিম্ন আয়ের দেশ ছিল ৬৪টি, এখন তা মাত্র ৩১টি। বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি আছে মধ্যম আয়ের দেশ। এই দেশগুলোর বেশির ভাগই ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একই জায়গায় রয়ে গেছে। বেশির ভাগ দেশ মধ্যম আয়ের দেশ হয়েই আছে, উচ্চ আয়ের দেশ হতে পারছে না। একে এখন বলা হচ্ছে মধ্যম আয়ের ফাঁদ। এ থেকে এমনকি রাশিয়া, চীন, ব্রাজিল বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশও বের হতে পারছে না।
তিনটি কারণে এবার বাংলাদেশ ২০২১ সালের আগেই মধ্যম আয়ের দেশ হতে পেরেছে। যেমন প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে ৬ শতাংশ হওয়ায় গড়ে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৪ শতাংশ হারে। দ্বিতীয়ত, জাতীয় আয়কে সূচক হিসেবে নেওয়ায় প্রবাসী-আয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফলে আয়ও বেশি দেখানো যাচ্ছে। আর ডলার ও টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকার সুবিধাও বাংলাদেশ পেয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, ডলারের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়ন হয় এবং এতে টাকায় জাতীয় আয় বাড়লেও ডলারে তা বাড়ে না।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দীর্ঘদিন ধরে এলডিসি নিয়ে কাজ করছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দ্রুততর সময়ে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ায় উৎফুল্ল হলেও তৃপ্ত হওয়া যাচ্ছে না। কারণ, কেবল আয় বৃদ্ধিকে এখন আর উন্নয়ন বলা যায় না। এ কারণেই এলডিসি থেকে উত্তরণকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ, এর সঙ্গে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনীতির ভঙ্গুরতার বিষয়টি জড়িত আছে। যেমন এক পণ্যের ওপর নির্ভরতা। বাংলাদেশ যেমন তৈরি পোশাকের মতো এক পণ্যে নির্ভর। সুতরাং এসব বিষয়ে নজর দিলেই বাংলাদেশ বেশি লাভবান হবে।