Published in Sokaler Khobor on Saturday, 24 May 2014.
রাজনৈতিক অস্থিরতা কমলেও বিনিয়োগ বাড়ছে না
আসাদুল্লাহিল গালিব
বিতর্কিত হলেও জানুয়ারিতে যে সংসদ নির্বাচন হয়ে গেছে, তারপর রাজনৈতিক সহিংসতা-তাণ্ডব-অস্থিরতা নেই। কিন্তু শিল্প-বাণিজ্যে আশানুরূপ বিনিয়োগ বাড়ছে না, বরং স্থবিরতা অব্যাহত রয়েছে। ফলে বেকারত্বের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না শিল্প-কারখানায় নতুন বিনিয়োগ।
২০১২-১৩ অর্থবছরের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল মাত্র ১১ দশমিক শূন্য চার শতাংশ। তা আগের মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫.৪৬ শতাংশীয় পয়েন্ট কম। ঋণ কমার কারণ বলা হয়েছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। কিন্তু চলতি অর্থবছরের (২০১৩-১৪) দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতির সময়ে সহিংসতা না থাকলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না।
ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) সাম্প্রতিকতম প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সহিংসতা না থাকলেও রাজনীতিতে অস্বস্তি রয়েছে। প্রায়ই রাজনৈতিক হিংসাত্মক ঘটনা ও শিল্প-দুর্ঘটনা
বিনিয়োগকারীদের সাহস কমিয়ে দিয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, বিদ্যুত্ ও রাস্তাঘাটসহ অনুন্নত অবকাঠামো এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বিনিয়োগ-স্থবিরতার অন্যতম কারণ। এগুলোর সমাধানে সরকারের জোরালো চেষ্টা নেই।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সকালের খবরকে বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আমদানি বৃদ্ধি ছাড়া অন্য কোনো আর্থিক সূচকের ভালো ফল দেখা যায়নি। সুতরাং বিরোধী দলগুলোর হরতাল-অবরোধ তথা রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ হওয়ার পরও দেশে বিনিয়োগ বাড়েনি, এটি প্রমাণিত। দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর জন্য রাজনৈতিক অস্বস্তি কমিয়ে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন সংগঠন প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের নিচে হবে বলে অনুমান করেছে। অর্থাত্ চতুর্থবারের মতো প্রবৃদ্ধির পতন ঘটবে এবং প্রথমবারের মতো প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে নেমে যাবে। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ইঙ্গিত অন্য রকম (৭.৩০%)। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, বিনিয়োগ-বন্ধ্যত্ব। এই বন্ধ্যত্ব রাজনৈতিক ডামাডোল বা হরতালের কারণে হয়নি, এর পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা রয়েছে। কিন্তু আগের ও বর্তমান সরকার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পরিবর্তনে সংস্কারের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান বা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, নতুন শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠায় চলতি অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) শিল্পে মেয়াদি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৩০ হাজার ৮৪৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩২ হাজার ১৫ কোটি ৪ লাখ টাকা। সে হিসাবে শিল্পে মেয়াদি ঋণ কমেছে ১ হাজার ১৬৬ কোটি ৯ লাখ টাকা বা ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
বেকারত্ব : ইকোনমিস্টের পর্যবেক্ষণে গত এক দশকে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়লেও শিক্ষার গুণগতমান বাড়েনি। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশজুড়ে ১৫ বছরের ওপরে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী রয়েছে ৫ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে কাজে নিয়োজিত রয়েছে প্রায় ৫ কোটি ৪১ লাখ। আর বেকার ২৬ লাখ। এটি মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সাড়ে ৮ শতাংশ এবং প্রতিবছর প্রায় ১৮ লাখ মানুষ নতুন করে বেকার বাহিনীতে যুক্ত হচ্ছে।
দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৩ কোটি ৯৫ লাখ পুরুষ এবং ১ কোটি ৭২ লাখ নারী। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আইএলও) তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০১৫ সালে মোট বেকারের সংখ্যা ৬ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
ঋণপ্রবাহ : চলতি মুদ্রানীতিতে জুন মাস নাগাদ বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। তবে মার্চ ’১৪ শেষে ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশ। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতির সময়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না-এটা এক প্রকার নিশ্চিত।
একইভাবে মার্চ ’১৪ শেষে সরকারি খাতে নিট ঋণের প্রবাহ বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত বছরের মার্চে ছিল ৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ। সে হিসাবে নিট ঋণের প্রবাহ প্রায় দ্বিগুণ কমেছে।
অলস টাকা : দেশের বিনিয়োগ মন্দা পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় উদ্বৃত্ত তারল্যের পাহাড় জমেছে। বর্তমানে প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকার তারল্য রয়েছে। আমদানিতে ধীরগতি আর রফতানি আয় তুলনামূলক বেশি হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে মাত্রাতিরিক্ত রিজার্ভ মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেয়। বিপুল পরিমাণের এই বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগে না আনতে পারলে দেশের কোনো লাভ হয় না।
গত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মতো চলতি অর্থবছরেও রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক ধারা চলছে। এতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১ হাজার ১৭২ কোটি ৭১ লাখ মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১ হাজার ২৩১ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। সে হিসাবে ১০ মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ৫ শতাংশ আর গত অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৬ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮১২ কোটি ৯০ লাখ টাকা, যা গত জুন মাসের তুলনায় ১০ দশমিক ৯৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে গত বছরের মার্চ মাসে এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আমানত বেড়েছিল ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। সে হিসাবে ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি অনেক কমে গেছে।
অবকাঠামো : অর্থনীতিবিদরা জানান, সরকার বিনিয়োগ বাড়ালে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়। ফলে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হয়। বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে এগিয়ে আসেন। সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থানের সুযোগ। এছাড়া দেশে অর্থের সরবরাহ বাড়ে, বাড়ে মানুষের আয় এবং সঞ্চয়। ফলে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু অর্থনীতির এসব নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায় সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
এর কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, সরকারের বিনিয়োগ ব্যয় বাড়লেও অবকাঠামো উন্নয়নে তা তুলনামূলক কম অবদান রাখছে। কারণ উন্নয়ন ব্যয়ে অপচয় বেশি হচ্ছে। তথ্যে দেখা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরের মধ্যে বিদ্যুত্ সরবরাহে খরচ ১৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুত্ ছাড়া অন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের ব্যয়ও তুলনামূলকভাবে বাড়ছে। ফলে সরকারি ব্যয় যে হারে বাড়ছে, সে হারে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে না। এতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উত্সাহ পাচ্ছেন না।
সূত্র জানায়, প্রতিকূল পরিবেশে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে অভ্যস্ত। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার চেয়ে এখানকার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, দুর্বল অবকাঠামো। ২০০৪ সালে কোটা ব্যবস্থা প্রত্যাহারের সময় অনেকে পোশাক শিল্পের ভবিষ্যত্ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তবে এর কোনো প্রভাব পোশাক রফতানির ওপর পড়েনি। আর এমন সময় দেশে তাজরীন বা রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনা ঘটল, যখন চীনের বাজার বাংলাদেশে আসার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হচ্ছিল। কারখানার উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশকে ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। এ অবস্থায় বিদ্যুত্-গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ এবং সড়ক ব্যবস্থা উন্নত করতে না পারলে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশকে পিছিয়ে পড়তে হবে। এজন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি বিনিয়োগ-সহায়ক নীতি প্রণয়ন করা জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।