Published in Shokaler Khobor on Tuesday, 27 May 2014.
বিনিয়োগের পথে কত কাঁটা!
আবদুল হাই রঞ্জু
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে হরতাল অবরোধের মতো টানা কর্মসূচি নেই। সঙ্গত কারণেই বিনিয়োগ উপযোগী সামাজিক স্থিতিশীলতা আশা করা যায়। কয়েক মাস আগেও বিরোধী জোটের সহিংস আন্দোলনের কারণে দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। গত ৫ জানুয়ারি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের পর বলতে গেলে বিরোধী জোটের আন্দোলনের কোনো উত্তাপই এখন নেই। একটি দেশে শুধু যে রাজনৈতিক সহিংস আন্দোলনের কারণেই অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তা নয়। আইনের শাসন কিংবা সুশাসনের অভাবে দেশে অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি কতটা জননিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়তে পারে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশই তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। গত ৮ মে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরামর্শক সভায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেছেন, দেশে সাম্প্রতিক সময়ে গুম, খুন, অপহরণের মহামারীর কারণে জীবনশঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগে ধস নেমেছে। তিনি আরও বলেছেন, বর্তমানে বিনিয়োগ উপযোগী স্বল্প সুদের ঋণের বদলে ১৮ শতাংশের সুদহারের কারণেও বিনিয়োগ কমে গেছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে শিল্প খাতে ব্যাংকঋণ সর্বোচ্চ ৯ শতাংশের মধ্যে রাখা জরুরি। পাশাপাশি আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান বা স্প্রেড ৩ শতাংশের মধ্যে রাখা উচিত। অর্থাত্ বর্তমানে ব্যাংকের সুদহার এত বেশি যে, শিল্পোদ্যোক্তারা এই উচ্চ সুদহারে বিনিয়োগ করে ব্যবসা-বাণিজ্যে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জনের বদলে বরং আর্থিক ক্ষতির মুখেই পড়ছেন। এর ওপর আবার বিনিয়োগ উপযোগী বিদ্যুত্, গ্যাস ও পানির স্বাভাবিক সরবরাহের অভাবে দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি এখন খুবই নাজুক।
সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) এক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, নীতি পরিবর্তনের অনিশ্চয়তা, সম্পদের নিরাপত্তাহীনতা এবং সঙ্কটময় ব্যক্তিজীবন—এই তিন কারণে দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অনেকে আশা করেছিলেন রাজনৈতিক সহিংসতা শেষ হলে দেশে স্বস্তি ফিরে আসবে এবং অর্থনীতি আবার চাঙ্গা হবে। কিন্তু নির্বাচনের পর গত চার মাসে বিনিয়োগ বাড়েনি, রাজস্ব আদায় কমে গেছে, এডিবির লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হয়েছে, গ্যাস-বিদ্যুতের অব্যবস্থাপনা কাটেনি, রেমিট্যান্সে পতন ঘটেছে। সংস্থাটির মতে, দেশে বিরাজমান পরিস্থিতি শুধু অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ নয়, অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। ফলে দেশ থেকে অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গত ১০ মে অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সঙ্গে আলোচনায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অকপটেই স্বীকার করে বলেন, দেশে বেসরকারি পর্যায়ের বিনিয়োগ না হওয়ায় অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। তিনি জোরের সঙ্গেই বলেছেন, বিনিয়োগে এখন মূল সমস্যা হল জমি। তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, এ সমস্যা সমাধানের সাতটি এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। একসঙ্গে সাতটি পাওয়া না গেলেও কাজ শুরু করা হবে। জমি দিতে পারলেই বিনিয়োগ-চিত্র পাল্টে যাবে। অবশ্য বিনিয়োগের জন্য গ্যাস-বিদ্যুত্ সঙ্কট, ব্যাংকঋণের চড়া সুদ, অবকাঠামো সমস্যার কথা বলেছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। বিদ্যুত্ সমস্যার বিষয়টি অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করে বলেন, বিদ্যুত্ উত্পাদনের ক্ষমতা ১১ হাজার মেগাওয়াট বলা হলেও উত্পাদন সাত হাজারের বেশি নয়, যা বাড়ানো জরুরি (সূত্র : অর্থনীতি প্রতিদিন, ১১ মে)। অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য যে যথাযর্থই তা বলাই বাহুল্য। মাঝেমধ্যে অর্থমন্ত্রী অপ্রিয় অথচ সত্য কথা বলে অনেকের বিরাগভাজন হন। তবুও তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বাস্তব অবস্থা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। যে যেভাবেই বলি না কেন বাস্তবতা হচ্ছে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি খুবই নাজুক। এর মূলে গ্যাস, বিদ্যুত্, পানি, জমির সঙ্কটের পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও অনেকাংশেই দায়ী। গত ৯ মে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) এক প্রতিনিধি দল সচিবালয়ে বিদ্যুত্ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করে লিখিত আকারে অভিযোগ প্রকাশ করেন, সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো অদক্ষ ও কার্যত ক্ষমতাহীন। আমলারা সিদ্ধান্ত দিতে অহেতুক দীর্ঘ বিলম্ব করেন। তারা বলেন, এদেশের উন্নয়নে আমরা আরও বেশি কাজ করতে চাই। কিন্তু সরকারকে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা আরও বলেন, যেখানে খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্ত সরকারিভাবে অনুমোদিত সময়ের (৬০ দিন) মধ্যেই হওয়া বাঞ্ছনীয়, সেখানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাতে কয়েক বছর লেগে যায়। সরকারি বিধিবিধানের এ রকম লঙ্ঘন তাদেরকে বিস্মিত করে। অবশ্য আমাদের দেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নতুন কিছু নয়, এ সমস্যা মোকাবেলায় ক্ষমতাসীনরা প্রতিশ্রুতি দিলেও কার্যত কেউই এর বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। এর মূলেই রয়েছে অপরাজনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সর্বোপরি রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন। অর্থাত্ যতদিন পর্যন্ত নিজেদের স্বার্থ, লোভ-লালসা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা যাবে না, ততদিন এ ব্যাধি নিরাময় করাও সম্ভব হবে না। কারণ সরকারিভাবে প্রতিটি কাজের দায়িত্ব সম্পাদন ও জবাবদিহিতা থাকে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর। তাদের দিয়ে কোনো কাজ করালে তারাও এর সুযোগ নিয়ে থাকে। ফলে আমাদের দেশে কথায় কথায় আইনের শাসন, ন্যায়-অন্যায় বোধের কথা বলা হলেও কার্যত পদে পদে নিয়মনীতির অপমৃত্যু ঘটছে, যা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সঙ্গত কারণেই প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য অবসানের বদলে প্রতিনিয়তই পাকাপোক্তই হচ্ছে। একমাত্র রাজনীতির দুর্বৃত্তপনা বন্ধ করা সম্ভব হলে সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তা কিংবা আমলা কারও পক্ষেই নিয়মনীতি কিংবা আইনের বাইরে কাজ করার কোনো সুযোগই থাকবে না। অথচ আমাদের দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে প্রশাসনের সকল পর্যায়ে অনিয়ম জাল-জালিয়াতি বেআইনি কাজ হয়ে থাকে, আর যাদেরকে ব্যবহার করে এক কাজ হয় তারা নির্বোধ শিশুর মতো শুধু শুধুই হুকুম তালিম করবেন, নিজেদের আখের গোছাবেন না, তা কী করে হয়? কথায় আছে, এক অন্যায় হাজার অন্যায়ের জন্ম দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে এর বাস্তব প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। এখন দেশে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও খুন, গুম হচ্ছে। আবার অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে। ঘর থেকে বের হয়ে ঘরে ফেরার ন্যূনতম নিশ্চয়তাটুকু আজ সাধারণ নাগরিক হারিয়ে ফেলছে। মনে হচ্ছে আইনের শাসনের অপমৃত্যু ঘটছে। এমনি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এরপরও ক্ষমতাসীনরা বলছেন, বিচ্ছিন্ন দুয়েকটি ঘটনা ছাড়া দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো। তাদের চোখে যেন কিছুই ধরা পড়ে না। অথচ আজ দেশের নিষ্পাপ শিশুটিরও কোনো নিরাপত্তা নেই। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জে ছয় বছরের এক শিশুকে অপহরণ করে তার দুটি কিডনি নিয়ে হত্যা করা হল। আজ দেশের মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টিটুকু পর্যন্ত কেন নেই—কে দেবে এর সদুত্তর? অর্থাত্ একটি দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক নিরাপত্তা, আইনের শাসনের ওপর নির্ভর করে দেশি বিদেশি বিনিয়োগ। বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়ে। আবার কর্মসংস্থান বাড়লে বেকারত্বও কমে। ফলে অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে। যা একে অপরের পরিপূরক। বিনিয়োগ বোর্ডের সূত্র মতে, গত ২০১২-১৩ অর্থবছর হতেই বিনিয়োগের সূচক নিম্নমুখী। অর্থাত্ গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে স্থানীয় বিনিয়োগ কমেছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা গত বছরের অক্টোবর থেকে। দেখা গেছে, গত অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর—এই পাঁচ মাসে ৩৮৪টি স্থানীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব জমা পড়েছিল। অথচ তার আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। সূত্র মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পোশাক খাতসহ বিভিন্ন পণ্যের বাজার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। চীনের ক্রেতারা বাংলাদেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে চলে যাচ্ছেন। গত বছরের জুলাইতে তুরস্ক ও জার্মানির ব্যবসায়ীরা টাইলস, তৈরি পোশাক, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখালেও শুধু বর্তমান পরিস্থিতির কারণে এখন তারা বাংলাদেশের প্রতি বিমুখ হয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি শ্রমিকদের যথাযথ কর্মপরিবেশ না থাকায় যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা স্থগিত করায় দেশের প্লাস্টিক, সিরামিকসহ কয়েকটি সম্ভাবনাময় রফতানি খাত ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্বীকার করতেই হবে, যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা স্থগিত হওয়ার কারণেও বিনিয়োগ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র টিকফার মতো চুক্তি করাতে বাংলাদেশ সরকারকে বাধ্য করলেও জিএসপি সুবিধা আদায় করতে ক্ষমতাসীনরা যে ব্যর্থই হয়েছেন তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে—তাহলে কেন এবং কোন যুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা স্বাক্ষর করা হল?
দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য টেলিকমিউনিকেশন, রেগুলেটরি বোর্ড, এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিনিয়োগ বোর্ড, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনকে সম্পূর্ণ দলীয় ও প্রভাবমুক্ত করে শক্তিশালী করতে হবে। সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি যেভাবেই হোক খুন, গুম ও অপহরণের ঘটনা বন্ধ করে ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে এনে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো সম্ভাবনাই তৈরি হবে না।
লেখক : সমাজসেবক