Published in Amader Shomoy on Thursday, 4 June 2015.
মীমাংসা হয়নি প্রধান বাধা রাজনৈতিক ইস্যুর
চলতি বাজেটেও বড় ঘাটতি
হারুন-অর-রশিদ
চলতি অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), রাজস্ব আয় ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় ধরনের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এই ব্যর্থতার জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতাকে দায়ী করেন সরকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। আজ সংসদে উপস্থাপন করা হবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য বিশাল আকারের বাজেট। আকার হতে পারে ২ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে বড় ধরনের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও আগামী অর্থবছরেও ঘোষণা করা হচ্ছে বিশাল বাজেট, যা বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা থাকছে।
সূত্র জানায়, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য গত বছর ৫ জুন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আকারের বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। এটি পাস হয়ে বছর জুড়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে অর্থবছরের ১১ মাস শেষ। কিন্তু কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
চলতি অর্থবছরে বাজেটের আকার ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। এতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। এটি বছর শেষে সাড়ে ৬ শতাংশ হতে পারে বলে সরকারি হিসেবে বলা হচ্ছে। বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে এই প্রবৃদ্ধি হবে ৬ শতাংশেরও নিচে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রবৃদ্ধির জন্য বেসরকারি বিনিয়োগের ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দরকার। কিন্তু বছর জুড়ে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর দ্বিতীয় ষাণ¥াসিকের প্রথম তিন মাসের রাজনৈতিক সহিংসতা বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে দেয়নি। অন্যদিকে ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি জেঁকে বসেছে, যার কারণে খেলাপি ঋণ ক্রমশ বাড়ছে। এর ফলে সুদ হার কমিয়ে আনা যাচ্ছে না। উচ্চ সুদ হার বিনিয়োগের অন্যতম বড় বাধা। এসব কারণে জিডিপিতে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে।
অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, জানুয়ারি-মার্চ এই তিন মাস দেশে চরমভাবে রাজনৈতিক সহিংসতা ছিল। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, প্যাট্রল ও ককটেল বোমা হামলায় অনেক ক্ষতি হয়। এই সহিংসতার কারণে কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। সহিংসতা না থাকলেও হয়তোবা ৭ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হতো।
এদিকে বাজেটের সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস রাজস্ব আদায়। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ১ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে দেশের অর্থনীতিতে স্থবির হয়ে পড়ায় কাক্সিক্ষত রাজস্ব আয় হয়নি। পরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। বিশাল আকারের আয়ের লক্ষ্যমাত্রার ঘাটতি হতে যাচ্ছে অনেক বেশি। বছর শেষে রাজস্ব আদায়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে। এই ঘাটতি সত্ত্বেও আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা আরও ৫৯ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে বলছে, চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আয়ে যেখানে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। সেখানে আগামী অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ৫৯ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো বাস্তবসম্মত নয়।
উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, আমরা আগেই বলেছিলাম চলতি বছরে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হবে। এবার লক্ষ্যমাত্রা অনেক বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য অর্থনীতির গতি নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকলেও অর্থনীতিতে গতি আসবে না।
চলতি অর্থবছরে এডিপির আকার ধরা হয় ৮০ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী অর্থবছরে দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) মাত্র ৫১ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ২ মাসে অবশিষ্ট ৪৯ শতাংশ বাস্তবায়ন একেবারেই অসম্ভব। রাজনৈতিক সহিংসতা ও অর্থের অভাবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। বাস্তবায়নে চরম ধীরগতির কারণে ইতোমধ্যে সংশোধন করে এডিপির আকার কমিয়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের এই নাজুক পরিস্থিতিতেও আগামী অর্থবছরের জন্য এডিপি ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, আর্থিক পরিকল্পনার গুণগত মানের ক্ষয় হয়েছে। যার ফলে অবাস্তব আকারে বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে। কিন্তু পরে সেটা আর বাস্তবায়িত হচ্ছে না। একদিকে অবাস্তব পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে অন্যদিকে দুর্নীতিমুক্ত করে সক্ষমতা অর্জনে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা হচ্ছে না। যার জন্য প্রতিবছরই বাজেটে অধিকাংশ সূচকে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে যে প্রধান বাধা রাজনৈতিক ইস্যু সেটির কোনো সমাধান হয়নি। জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি বারবার উত্তপ্ত হচ্ছে। এই রাজনৈতিক ইস্যুর সমাধান না হলে বাজেটে বাস্তবায়নের সংশয় থেকেই যাবে। রাজনৈতিক ইস্যু ছাড়াও অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। এ সমস্যা দূর করতে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও বছর শেষে তা বাস্তবায়ন হয়নি।
সিপিডির আরেক গবেষক তৌহিদুল ইসলাম বলছেন, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সরকার দুটি বাজেট তৈরি করছে। একটি জনসম্মুখে প্রকাশ করে বাহবা নিতে বিশাল আকারের বাজেট। অন্যটি বাস্তবায়নের নিরীখে।
এফবিসিসিআই সদ্যবিদায়ী সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় নিয়ামক হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। জাতীয় নির্বাচন বর্ষপূর্তি কেন্দ্রিক দেশে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক সহিংসতা জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। নিশ্চিয়তা ছাড়া বিনিয়োগকারীরা বড় ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না। কাক্সিক্ষত উন্নয়নে জন্য যথাযথ বিনিয়োগবান্ধ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজেটে কর রেয়াত, ইকোনমিক জোন বা অন্য যে কথাই শোনানো হোক না কেন- রাজনৈতিক অস্থিরতা না কাটলে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা নেই। বিনিয়োগের জন্য সরকারকে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে হবে।