Published in Kaler Kantho on Sunday, 31 August 2014.
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে জিইডির মধ্যবর্তী মূল্যায়ন
অনেক সূচকই অপূর্ণ
আরিফুর রহমান
২০১৫ সালের মধ্যে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ শতাংশে উন্নীত করা হবে; একই সময়ের মধ্যে এক কোটি চার লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে- ২০১১ সালে অনুমোদিত সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদি ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সুস্পষ্টভাবে এ অঙ্গীকার করা হয়েছিল। চার বছর পর ওই পরিকল্পনা দলিল মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেখা গেল, বাস্তবতার সঙ্গে প্রতিশ্রুতির কোনো মিল নেই। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ এখনো জিডিপির ২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর এই সময়ে কর্মসংস্থান হয়েছে ৬০ লাখ। বাকি এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এ দুটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কোনো সম্ভাবনা নেই। নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার পরিকল্পনাও ভেস্তে গেছে। কেননা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা বলা হলেও এখন তা রয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) মধ্যবর্তী মূল্যায়নে এসব চিত্র উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ, জিডিপির প্রবৃদ্ধি, জিডিপির সঙ্গে কর আদায়ের অনুপাত, সুশাসন নিশ্চিত করাসহ বেশির ভাগ প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। আগামী তিন সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি প্রকাশ করার কথা রয়েছে। এতে অর্থমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রীসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
জানা যায়, ২০০৯ সালে প্রথম মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর উন্নয়ন সহযোগীদের চাপিয়ে দেওয়া দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র (পিআরএসপি) বাদ দিয়ে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অর্থনীতিবিদ, গবেষণা সংস্থা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে ২০১১ সালে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদন দেওয়া হয়। যদিও মাঝপথে এসে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় থাকা অঙ্গীকারগুলোকে উচ্চাভিলাষী বলে অভিহিত করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগসহ (সিপিডি) বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতিবিদদের অভিযোগ, বাস্তবতা বিবেচনা না করে পরিকল্পনা প্রণয়নের কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বিষয়ে গত ৪ মে এক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, এ পরিকল্পনা সম্পূর্ণ অকার্যকর। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে এই পরিকল্পনা দলিল নেওয়া হয়েছিল, তা অর্জিত হয়নি।
জিইডির মধ্যবর্তী মূল্যায়নে দেখা গেছে, সুশাসনের ক্ষেত্রে সরকারের যেসব প্রতিশ্রুতি ছিল, চার বছর পেরিয়ে গেলেও আশানুরূপ কোনো সাফল্য আসেনি। এ ক্ষেত্রে সরকারকে আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। মধ্যবর্তী মূল্যায়নে সরকারকে বেশ কয়েকটি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য যেসব কৌশল নেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করতে হলে কিছু বিষয়ে দ্রুত মনোযোগ দিতে হবে। এর মধ্যে একটি হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কার্যকর ও শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি বিচারিক কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করতে হবে। যাতে করে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়।
জানতে চাইলে এই প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মধ্যবর্তী মূল্যায়নে কয়েকটি বিষয়ের ওপর নজর দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের মতো করে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দেওয়া। আইন যেভাবে আছে, তারা যেন তা বাস্তবায়ন করতে পারে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। এ ছাড়া মামলা নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লেগে যায়। এ জন্য দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিতে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রতিবছর গড়ে ৭.৩ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত করার অঙ্গীকারও করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত চার অর্থবছরে গড়ে ৬.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, যা ৭ শতাংশের চেয়ে অনেক পেছনে। গত চার অর্থবছরে যেখানে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশই অর্জিত হয়নি, সেখানে বাকি এক বছরে যে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না, তা স্পষ্ট করে ওই মধ্যবর্তী মূল্যায়নে বলা হয়েছে। তবে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত না হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করে জিইডি বলছে, ২০০৯ সালের বিশ্ব মন্দার ঢেউ বাংলাদেশেও পড়েছে। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ যে হারে আশা করা হয়েছিল, তাও হয়নি। এর সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা তো ছিলই। এসব কারণে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়নি বলে মনে করে জিইডি।
২০১১ সালে অনুমোদিত ওই পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, ২০১৫ সাল নাগাদ সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ৩২ শতাংশে উন্নীত করা হবে। ওই বছর বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২৪ শতাংশ। কিন্তু মধ্যবর্তী মূল্যায়নে দেখা গেছে, চার বছর পর এখন সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ হয়েছে জিডিপির ২৮.৬৯ শতাংশ। বাকি এক বছরে তা ৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৩২ শতাংশে উন্নীত করা যে সম্ভব হবে না তা সহজে অনুমেয়। আগামী অর্থবছর সরকারি বিনিয়োগ সাড়ে ৭ শতাংশে উন্নীত করার কথা। সেটি এখন আছে ৬.৯ শতাংশ। আর বেসরকারি বিনিয়োগ ২৫ শতাংশে নেওয়ার কথা আগামী এক বছরের মধ্যে। যেটি এখন অবস্থান করছে ২১.৪ শতাংশে।
এমনিভাবে দারিদ্র্যের হার কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাও অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ ২০১৫ সাল নাগাদ দারিদ্র্যের হার কমিয়ে ২২.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার রয়েছে। মধ্যবর্তী মূল্যায়নে দেখা গেছে, সর্বশেষ দারিদ্র্যের হার ২৬.২ শতাংশে অবস্থান করছে। প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হলে বাকি এক বছরে দারিদ্র্যের হার প্রায় ৪ শতাংশ কমাতে হবে; যা সরকারের জন্য দুরূহ হবে।
মধ্যবর্তী মূল্যায়নে আরো বলা হয়েছে, সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব আগামী বছর নাগাদ ৩৩ শতাংশে উন্নীত করার কথা রয়েছে। বর্তমানে তা ২৫ শতাংশে রয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে তা লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারিকরণ কমিশনকে কার্যকর করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। চার বছরেও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব বা পিপিপি মডেলকে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। পদ্মা সেতুসহ চার লেন ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট রয়েই গেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিনিয়োগের অপ্রতুলতা, বিশ্ব মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে গত চার অর্থবছর কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়নি। তবে গড়ে ৬ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জন কম সাফল্যের নয়। কারণ, গত চার বছরে চীন, ভারতসহ মাত্র ছয়টি দেশ ৬ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এ ছাড়া অন্যান্য সূচকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও কাছাকাছি রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ, বৈদেশিক লেনদেনসহ বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ অসম্ভব সাফল্য পেয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার যখন এমন হাল, ঠিক তখনই সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে জিইডি। গত বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে ওই পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এতে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০১৬-২০) প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ : প্রত্যেক নাগরিকের ক্ষমতায়ন’। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, আসছে পাঁচশালা পরিকল্পনায় মানব সম্পদ উন্নয়ন ও যুগোপযোগী শিক্ষা, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরের পরিকল্পনাও থাকবে।