Published in Jaijaidin on Saturday, 17 January 2015.
বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ
অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি রাজনৈতিক অস্থিরতা
সাম্প্রতিক উন্নয়নের পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিবেশ স্বাভাবিক রাখা জরুরি বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ অর্জন করা কঠিন হবে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও মানব সম্পদ উন্নয়নে অবকাঠামোগত সংস্কারের তাগিদ
মেসবাহুল হক
বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি রাজনৈতিক অস্থিরতা। এজন্য সাম্প্রতিক উন্নয়ন ধরে রাখতে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিবেশ স্বাভাবিক রাখা জরুরি। একই সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সম্পদের সুষম বণ্টন এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সহযোগিতা বাড়ানোসহ মানবসম্পদ উন্নয়নে অবকাঠামোগত সংস্কারের তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি। চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণে এই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ধারণা, ২০১৫ সালে বাণিজ্যে বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। অর্থনীতির বাজারও মন্দা। এছাড়া তেলের অব্যাহত দরপতনে ক্ষতির মুখে উৎপাদনকারী দেশগুলো। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস, ভারতের অর্থনীতির গতিতে পরিবর্তন আসবে। বাংলাদেশ ও নেপালের অর্থনীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রবাসী আয় অর্জনের মাধ্যমে দেশ দুটি অর্থনীতির ধারা বজায় রাখতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে।
এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ শাখার প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসাইন যায়যায়দিনকে জানান, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে বলে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। মূলত প্রবৃদ্ধি একটু বাড়বে বলে আশা করা হয়েছিল ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থনীতির কয়েকটি ইতিবাচক সূচকের ওপর ভিত্তি করে। যেমন, তার আগের ৬ মাসের তুলনায় জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি বেড়েছিল, প্রবাসী আয় বেড়েছিল। তাই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিস্তর সমস্যা থাকা সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২ প্রাক্কলন করা হয়েছিল।
তিনি আরো জানান, গত অর্থবছরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা না থাকলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটা আস্থাহীনতার পরিবেশ বিরাজ করছিল। একই সঙ্গে আশঙ্কা করা হয়েছিল, আবার রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থিতিশীল হতে পারে। আর পরিবেশ যদি অস্থিতিশীল হয়, তাহলে ৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সম্ভব হবে না। আশঙ্কা সত্য হয়েছে। এ বছরের প্রথম থেকেই রাজনীতির মাঠ আবার উত্তপ্ত হয়েছে, যা অর্থনৈতিক কর্মকা-কে চরমভাবে ব্যাহত করছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এই অস্থিতিশীলতার শেষ কবে, তা ধারণা করা যাচ্ছে না। তাই বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ অর্জন করাই কঠিন হবে।
তবে দাতা সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, চলতি অর্থবছরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি ভালো হবে। গত অর্থবছরে উন্নয়নশীল দেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৪। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ৮ হবে।
বিশ্ব অর্থনীতির বিষয়ে এতে বলা হয়েছে, ৪ ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। এগুলো হলো দুর্বল বিশ্ববাণিজ্য, সুদের উচ্চ হার, জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়া এবং দীর্ঘ মেয়াদে ইউরো অঞ্চলের সঙ্কট, বিশেষ করে জাপানের নতুন অর্থনৈতিক সঙ্কট।
প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়ে বলছে, চলতি (২০১৫) সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে হতে পারে ৩ দশমিক ২ শতাংশ, যা ২০১৪ সালে হয়েছে ২ দশমিক ৬ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি হতে পারে চলতি ২০১৫ সালে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, যা ২০১৪ সালে হয়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৬ সালে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ।
প্রতিবেদন সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক গ্রুপ প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম জানান, বর্তমানে অনিশ্চিত অর্থনীতির সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উচিত তাদের সম্পদের সুষম বণ্টন এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সহযোগিতা বাড়ানো। সেই সঙ্গে মানবসম্পদ উন্নয়নে অবকাঠামোগত সংস্কার আনতে হবে।
তিনি আরো জানান, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে। কেননা, বেসরকারি খাতই হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বৃহৎ উৎস। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে ১০০ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা সম্ভব।
এদিকে, বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি (২০১৪-১৫) অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে ১৪ শতাংশ। অর্থনীতিবিদ এবং উদ্যোক্তারা বলছেন, প্রায় এক বছর যাবৎ দেশে কোনো উত্তপ্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় বছরজুড়েই ছিল রাজনৈতিক পরিবেশে আস্থার সঙ্কট। ফলে নতুন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হয়নি। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা, অবকাঠামো, গ্যাস-বিদ্যুতের অপ্রতুলতা এবং ব্যাংকের চড়া সুদ তো ছিলই। তাছাড়া ২০১৫ সালের প্রথম থেকেই শুরু হয়েছে হরতাল-অবরোধ বা নৈরাজ্যও। তাই এই বন্ধ্যত্ব থেকে আপাতত মুক্তির পথ দেখছেন না তারা।
বিনিয়োগ বোর্ডের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশীয় বিনিয়োগকারীদের মতো সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক অর্থাৎ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভালোই সাড়া ছিল। ওই তিন মাসে ২৭৪টি প্রকল্পে ২৯৫ কোটি (২ হাজার ৯৫০ মিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব নিবন্ধন হয়। এর মধ্যে ২৩৭টি দেশি প্রকল্পে ৮৮ কোটি (৮৮৩ মিলিয়ন) ডলার এবং ৩৭টি বিদেশি প্রকল্পে ২০৬ কোটি ৬ লাখ (২ হাজার ৬৬ মিলিয়ন) ডলার। কিন্তু চলতি অর্থবছরের একই সময়ে, অর্থাৎ গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে ৩৪৫টি প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধন হয়েছে ২৫৭ কোটি ৩ লাখ (২ হাজার ৫৭৩ মিলিয়ন) ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছর বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। এর মধ্যে দেশীয় ৩১৮টি প্রকল্পে ২৩৫ কোটি ৩ লাখ (২ হাজার ৩৫৩ মিলিয়ন) ডলার এবং ২৭টি বিদেশি প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধন হয়েছে মাত্র ২১ কোটি ৯ লাখ (২১৯ মিলিয়ন) ডলার।
এ ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যায়যায়দিনকে জানান, বর্তমানে দেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে বিনিয়োগ বন্ধ্যত্ব। বিনিয়োগ কমতে শুরু করে ২০১১ সাল থেকে। তাই প্রমাণিত হয়, এই বন্ধ্যত্ব শুধু রাজনৈতিক ডামাডোল বা হরতালের কারণে হয়নি, এর পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতাও রয়েছে। কিন্তু আগের এবং বর্তমান সরকার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পরিবর্তনে সংস্কারের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান বা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
অর্থনীতিবিদরা জানান, সরকার বিনিয়োগ বাড়ালে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়। ফলে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে এগিয়ে আসেন। সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থানের সুযোগ। এছাড়া দেশে অর্থের সরবরাহ বাড়ে, বাড়ে মানুষের আয় এবং সঞ্চয়। ফলে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু অর্থনীতির এসব নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায় সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে।
এর কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, সরকারের বিনিয়োগ ব্যয় বাড়লেও অবকাঠামোগত উন্নয়নে তা তুলনামূলক কম অবদান রাখছে। কারণ, উন্নয়ন ব্যয়ে অপচয় বেশি হচ্ছে। তথ্যে দেখা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহে খরচ ১৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুৎ ছাড়া অন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের ব্যয়ও তুলনামূলকভাবে বাড়ছে। ফলে সরকারি ব্যয় যে হারে বাড়ছে, সেই হারে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে না। এতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহ পাচ্ছেন না।