Published in The Daily Inquilab on Wednesday, 14 May 2014.
বিনিয়োগে স্থবিরতা কাটেনি
আজিবুল হক পার্থ
গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা কেটে গেলেও বিনিয়োগে স্থবিরতা কাটেনি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না থাকায় যেকোন মুহূর্তে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হয়ে ওঠার শঙ্কায় বন্ধ আছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। এর সাথে যুক্ত হয়েছে দেশব্যাপী ব্যবসায়ী অপহরণ আতঙ্ক। এই ভয়াবহতায় অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে পড়েছে। অবস্থার পরিবর্তন না হলে দেশে নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে না। বরং সচল শিল্প-কারখানাও বন্ধ হয়ে যাবে। অথচ শিল্পখাতে বিনিয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত অলস টাকা ব্যাংকে পড়ে রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্ভাবনাময় বাংলাদেশে চলমান দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কমতে থাকে গত বছরের শুরু থেকেই। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের কর্মসূচিতে উতপ্ত রাজপথের সাথে যুক্ত হয় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের পক্ষে-বিপক্ষের অবস্থান। গত বছর জুড়েই ছিল হরতাল-অবরোধ, বিক্ষোভ-সমাবেশ ও ঘেরাওয়ের কর্মসূচি। তবে কর্মসূচির ভয়াবহতা সৃষ্টি হয় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ আর জ্বালাও পোড়াওয়ের মাধ্যমে। দেশের বিরাজ পরিস্থিতিতে কমে আসে বিনিয়োগ। এ সময় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সাথে দেশি বিনিয়োগকারীও হাত গুটিয়ে বসে আছে।
তবে বিশ্লেষকদের মতামত ছিল দেশে একটি স্থিতিশীল সরকার আসলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আসবে। কিন্তু ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন প্রধান বিরোধী দলসহ বেশিরভাগ দলই নির্বাচন বর্জন করে। আর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে গঠিত হয়েছে সরকার। রাজনৈতিক পরিবেশও স্থিতিশীল। তবে বিনিয়োগ বাড়েনি। এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন বর্তমান সরকার সেই অর্থে জনগণের ভোটে নির্বাচিত না। আর বিরোধী প্রতি মুহূর্তে নির্বাচনের জন্য আহ্বান জানিয়ে আন্দোলনের হুমকি দিয়ে আসছে।
যেকোনো মুহূর্তে তারা কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারে। এই অবস্থা বিনিয়োগ করে ঝুঁকি নিতে চাইছে না বিনিয়োগকারী। তাদের মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি হলে তার স্থায়িত্ব আসেনি। সরকারের মেয়াদ নিয়েও বিভিন্ন মহলে রয়েছে প্রশ্ন এ জন্যই বিনিয়োগের সংকট কাটছে না। সিপিডির সিনিয়র গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান ইনকিলাবকে বলেছেন, বিনিয়োগ না হওয়ার জন্য রাজনৈতিক স্থিতি না থাকাটাই বড় কারণ। সেই সাথে বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের একটা অস্থির পরিবেশ ও বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগের ঘাটতি এর কারণ আছে। এক্ষেত্রে তিনি রাজনৈতিক পরিবেশের স্থায়িত্ব নিয়ে আস্থার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিগত নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না থাকায় এই সরকার স্থায়িত্ব নিয়েও সর্বমহলে প্রশ্ন রয়েছে। তাই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। এছাড়াও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ কম হচ্ছে বলে মনে করেন এই গবেষক।
জানা গেছে, বিনিয়োগ বাড়াতে কর প্রণোদনাসহ নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও বিনিয়োগে স্থবিরতা কাটেনি এখনও। নির্বাচনের বছর রাজনৈতিক সহিংসতায় বিনিয়োগে ধস নেমেছিল। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অবকাঠামো সমস্যা এর বিশেষ কারণ বলে দাবি করেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। তারা বলেছেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও অবকাঠামো সমস্যার সমাধান না হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে না। বিনিয়োগ বোর্ড বলেছে, বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই প্রস্তাব আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে এখনও রয়েছে আস্থাহীনতা। শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ থাকলে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ বাড়বে।
বিনিয়োগ বোর্ডে সূত্র জানায়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে মোট ৪৩২টি শিল্প নিবন্ধিত হয়েছে। আর প্রস্তাবিত বিনিয়োগের মোট ১৫ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। তবে এই বিনিয়োগ প্রস্তাবকে বিনিয়োগ বোর্ডের পক্ষ থেকে গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় ১৬৬৯ কোটি টাকা বেশি। শেষ তিন মাসের তুলনায় ১২.০৭ ভাগ বেশি বলা হচ্ছে।
তবে বিগত দিনের বিনিয়োগের চিত্র বিশ্লেষণ করলে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। গত অর্থবছরে (২০১২-১৩) দেশে ৬৬ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। যা ২০১১-১২ অর্থবছরে ছিল ৮৭ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকার। সে হিসাবে দেশে বিনিয়োগ কমেছে ২১ হাজার ২০৭ কোটির টাকারও বেশি। এর মধ্যে দেশি বিনিয়োগ হয়েছে ৪৪ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরে ছিল ৫৩ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। আর বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ২২ হাজার ৭২ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরে ছিল ৩৪ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। বিদায়ী ২০১২-১৩ অর্থবছরে মোট শিল্প নিবন্ধন হয়েছে ১ হাজার ৬৭৬টি। যা আগের অর্থ বছরে ছিল ১ হাজার ৯৫৬টি। সে হিসাবে শিল্প নিবন্ধন কমেছে ২৮০টি।
২০১৩ পঞ্জিকা বছরে আগের বছরের তুলনায় বিনিয়োগ কমেছে ৮ শতাংশ। ২০১৩ পঞ্জিকা বছরে দেশি-বিদেশি মিলে ৮০৬ কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। আগের বছর এটি ছিল ৮৬৯ কোটি ডলার। সেই হিসাবে এ বছরের হিসাবের সাথে গত বছরের মোট বিনিয়োগের দিকে তাকালে এই বিনিযোগ বেশি নয় বরং স্থিতি বলা যায়। বছরের মোট বিনিয়োগ প্রস্তাবের তুলনায় তিন মাসের বিনিয়োগ প্রস্তাবের চিত্র এমনটিই মনে হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছে গত বছর ছিল রাজনৈতিক সহিংসতার বছর। সেই হালেই চলছে এ বছর তাই কিছটা বেশি বা কম বলা যেতে পারে। তবে জাতীয় নির্বাচনপরবর্তী যে ধরনের বিনিয়োগের আশা করেছিলাম তা হয়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুটা বাড়ছে দেখা গেলেও সামগ্রিক অর্থনীতির চিত্র সেটা বলছে না। তবে বিনিয়োগের চিত্র জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে অর্ধেকে নেমে আসে। পরে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তুলনামূলকভাবে বিনিয়োগ কমেছে। অতি সম্প্রতি বিনিয়োগের প্রভাব কিছুটা বাড়লেও একে স্বাভাবিক বলা যাচ্ছে না।
নির্বাচনের পরে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি থাকলেও উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দেশব্যাপী সহিংসতা রাজনৈতিক অস্থিরতার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এর সাথে অতি সম্প্রতি দেশব্যাপী ব্যবসায়ীদের অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় ও হত্যার ঘটনায় নতুন করে বিনিয়োগে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সিপিডির সাম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, সবার মধ্যে ধারণা ছিল কোনো রকম একটি নির্বাচন হয়ে গেলে অর্থনীতি আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে। কিন্তু, এ মুহূর্তে এটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বিনিয়োগের আস্থা ফিরে আনতে হলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে অস্বস্তিও অনিশ্চিয়তা কাটবে না। তিনি বলেন, আমরা অনেকেই ভেবেছিলাম একটি নির্বাচন হয়ে গেলেই বিনিয়োগ বাড়বে, অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। কিন্তু তা হয়নি। অর্থনৈতিক সূচকে দেখেছি, রাজস্ব আদায়ের বৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে, ব্যক্তিখাতে ঋণ প্রদানের হার বাড়েনি, রফতানি বৃদ্ধির হার কমে গেছে, রেমিটেন্স্যার আয়ের পতন ঘটেছে। নির্বাচন হয়েছে, তারপর পরিস্থিতি শান্ত হলেও অনিশ্চয়তার জন্য স্বস্তি ও আস্থার পরিবেশ ফিরে আসেনি।
এদিকে দেশে বিনিয়োগে স্থবিরতা থাকায় ব্যাংকে পড়ে আছে অলস টাকা। এর পরিমাণ ক্রমশে বাড়ছে। গত বছরে দেশে চরম তারল্য সংকট ছিল। উদ্যোক্তারা ঋণের জন্য ব্যাংক থেকে ব্যাংকে ধরনা দিতো। সেখানে এখন ব্যাংকে ঋণ প্রদানের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কোনো গ্রাহক পাচ্ছে। এমন কি আগে সুদের হার কমানোর জন্য বিভিন্ন মহল থেকে বলেও লাভ না হলেও এখন ব্যাংক নিজের থেকেই সুদহার কমিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশের উদ্ধৃত তারল্যের পরিমাণ লাখ কোটি ছাড়িয়ে যায়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকের হাতে উদ্ধৃত তারল্য ছিল ৯৫ হাজার ৫৮০ কোটি ৭১ লাখ টাকা। নভেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার ৭৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। অক্টোবরে ৮০ হাজার কোটি টাকা এবং সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলোর হাতে উদ্ধৃত তারল্য ছিল ৭২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ রাজনৈতিক অস্থিরতায় স্থবির অর্থনীতির কারণে প্রতি মাসে ব্যাংকের উদ্ধৃত তারল্যের পরিমাণ বেড়েছে ৫ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তারল্য দাঁড়ায় এক লাখ কোটি টাকায়। তবে এপ্রিল শেষে তারল্য কিছুটা কমেছে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো আমানতের অর্থ বিনিয়োগ করতে না পেরে সুদের হার কমিয়েছে। বর্তমানে মেয়াদি আমানতের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ব্যাংকের সুদের হার ১১ শতাংশ, যা গত কয়েক মাস আগেও ১৩ শতাংশ ছিল। আর ব্যাংকগুলোর হাতে উদ্ধৃত তারল্য বেশি থাকার অর্থ হলো তারা বিনিয়োগযোগ্য তহবিলকে কাজে লাগাতে পারছে না। যেহেতু ঋণ থেকে আয়ই ব্যাংকের প্রধান আয়, এ কারণে ঋণ দিতে না পারায় ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যায়। এতে অনেক ব্যাংক লোকসানের সম্মুখীন হয়। ব্যাংকগুলোর হাতে বেড়ে যাওয়া অলস টাকার পরিমাণ উদীয়মান মূল্যস্ফীতিকে আরো বাড়াতে সহায়ক হবে বলে আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।