Published in Manobkantha on Wednesday, 21 May 2014.
পদ কেনা-বেচা
মামুন রশীদ
গত কয়েক সপ্তাহে নিজের লেখায় রাজনীতির শুদ্ধতার বিষয়টি ঘুরে ফিরে এসেছে। এ সপ্তাহে চেয়েছিলাম পাঠকের কাছে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে হাজির থাকব। কিন্তু বিধি বাম। কেন অন্য বিষয় নির্ধারণ করতে পারলাম না? তার কারণ দেখাতে পাঠকের দরবারে ১৫ মে, তারিখে বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত একটি খবরের সারাংশ তুলে ধরছি। ওই দিন বিকেলে বগুড়া প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন বিএনপির ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারা। সেখানে তারা অভিযোগ করেন, বগুড়ায় বিএনপির ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটিগুলোতে টাকা ছাড়া পদ-পদবি মেলে না। অর্থের বিনিময়ে নেতৃত্ব পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে তা নবায়নের জন্য চাওয়া হয় বাড়তি টাকা। তবে চাহিদা মেটাতে না পারলে সেই পদ-পদবিও আবার কেড়ে নেয়া হয়। বগুড়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে সদর উপজেলার অধীন সব ইউনিয়ন কমিটির পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ফাঁপোড় ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. এনামুল হক খোকন। এর তিন দিন পরে, ১৮ মে রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘রাজনৈতিক দল ও বাংলাদেশের গণতন্ত্র’ শিরোনামের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করা হয় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পক্ষে। গবেষণাপত্রে বলা হয়, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র নেই। নেতৃত্ব বাছাই থেকে মনোনয়ন সব ক্ষেত্রেই গণতন্ত্রচর্চার অভাব। আর এর প্রভাব পড়ছে রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থাতে। এমনকি দলগুলো তাদের গঠনতন্ত্রের ঘোষণাগুলোও মেনে চলছে না। শীর্ষ নেতৃত্ব একতরফা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তার বিরোধিতা করার আগ্রহ বা সাহস নেই অন্যদের। তৃণমূলে নানা শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে দুর্নীতি ও লুটপাটের বিস্তার ঘটানো হচ্ছে। ফলে আন্তঃদলীয় কোন্দল প্রকট হয়ে উঠছে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত এই দুটি প্রতিবেদনের মাঝে রয়েছে একটি যোগসূত্র। প্রথম সংবাদে সরাসরি অভিযোগ করা হয়েছে, আর দ্বিতীয়টিতে উঠে এসেছে প্রথম অভিযোগের পেছনের বিভিন্ন দিক। আমাদের রাজনীতি যে কালো বৃত্তের মাঝে বন্দি, তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রাজনীতি এখন মুষ্টিমেয় মানুষের পকেটে বন্দি। এই মুষ্টিমেয় মানুষগুলোর হাতে রয়েছে টাকা, রয়েছে পেশিশক্তি। ফলে বৃত্তের বাইরে আসার সুযোগ ঘটছে না। বগুড়া বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা যে অভিযোগ করেছেন, তার সত্যতা কতখানি, তা তদন্ত সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে এর মাঝে যে মিথ্যে লুকিয়ে নেই, তা বুঝতেও কষ্ট কল্পনার আশ্রয় নিতে হয় না। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি আমাদের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল। নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচার সরকার পতনের পর থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা এ দুই দলের মাঝেই ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রধান দুইটি দলের একটির তৃণমূল নেতারা অভিযোগ করেছেন নেতৃত্ব প্রশ্নে, তাতে অন্যদলের সমর্থকদের আহ্লাদিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, একই জেলায় অন্য দলটির দিকে তাকালে, এ রকম স্পষ্ট অভিযোগের দেখা না মিললেও, তৃণমূল থেকে জেলা পর্যায়ের কমিটি যে একটি বৃত্তের ভেতরে বন্দি, তা স্পষ্ট হয়। নব্বইয়ের পর যখন আমাদের রাজনীতিতে গতি সঞ্চার হচ্ছে, পরিবর্তন আসছে বলে আমরা আশাবাদী হয়ে উঠেছি, সেই সময়ের পর থেকে গত এক দশকের বেশি সময়ে এ জেলায় বিএনপির নেতৃত্বের পরিবর্তন এলেও, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন আসেনি। একই বৃত্তের মাঝে রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে। বিএনপিতে নেতৃত্বের পরিবর্তন যেমন গুণগত মানের রদলবদলের জন্য হয়নি, হয়েছে ভিন্ন কারণে। তেমনি আওয়ামী লীগে যে কোনো পরিবর্তনই আসেনি, তার কারণও কিন্তু গুণগত মান ধরে রাখার তাগিদ থেকে নয়, বরং এখানেও রয়েছে আলাদা কারণ। এ জেলায় আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব পরিবর্তনের জন্য দলের কাউন্সিল হয়েছে প্রায় নিয়মিতই। কিন্তু নতুন কোনো নেতা উঠে আসতে পারেননি। কারণ যে কৌশলের ফ্রেমে রাজনীতি বন্দি, তাকে মুক্ত করার মতো কোনো রূপকথার রাজপুত্র তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে এসে পৌঁছেননি। আর তাই বগুড়ায় বিএনপির সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বিএনপির সাবগ্রাম ইউনিয়ন কমিটির সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া ফরিদ উদ্দিন সরকার বলেছেন, তিনি সভাপতি পদের জন্য ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে নতুন করে দাবিকৃত অর্থ দিতে না পারায় তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তার উত্থাপিত এই অভিযোগের পর, স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, অর্থের বিনিময়ে রাজনীতির পদ পাওয়ার এই যে প্রচেষ্টা, এর অর্থ রাজনীতি তাহলে লাভজনক একটি মাধ্যম? কারণ টাকার বিনিময়ে পদ নিচ্ছি, পদ ধরে রাখতেও দাবি করা হচ্ছে টাকা, বিনিয়োগকৃত এই টাকা উঠে আসবে কীভাবে? নিশ্চয় সেই পথ রয়েছে, তাই তিনি যেমন টাকা দিয়ে পদ নিয়েছেন, আবার অন্যপক্ষে টাকার বিনিময়ে পদ ধরে রাখা, পদ ধরে রাখার জন্য পকেট কমিটি তৈরি করার প্রক্রিয়াও থেমে থাকছে না। তাই একই পদে কোনো পরিবর্তন ছাড়াই বছরের পর বছর একজন নেতা থেকে যাচ্ছেন। নতুন কোনো নেতা নির্বাচিত হতে পারছে না। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ, তাদের বিরুদ্ধে দলের ভেতরে তো নয়ই, অন্য কোনো পক্ষ থেকেও তদন্ত হচ্ছে না। দোষীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে না, বিচারে আওতায় আনা হচ্ছে না। ফলে সবসময় রাজনীতিতে যে স্বচ্ছতার কথা বলা হচ্ছে, তা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাজনীতি বলতে রাষ্ট্রশাসনের বা রাষ্ট্রপরিচালনার যে নীতির কথা বলা হয়, তারও দেখা মিলছে না।
একটি গল্প মনে পড়ছে। গল্পটির অনেকেরই জানা, তবুও লেখার ধারাবাহিকতা না রেখে গল্পটি বলেই শেষ করে দিচ্ছি আজকের লেখাটি। দুই ভাই। বড় ভাই একটু বোকাসোকা। গাঁয়ের লোকের ভাষায়, পাগল। দুই ভাইয়েরই বিয়ের বয়স হয়েছে। কিন্তু বড় ভাইয়ের বিয়ের কনে মেলা ভার। এ জন্য তো আর ছোট ভাইকে বসিয়ে রাখা যায় না। তাই ঠিক হলো বড় ভাইকে রেখে ছোট ভাইয়ের বিয়ে দেয়া হবে। বড় ভাই এতে কিছু মনে করে না, তার সে মনই নেই। বিয়ের দিন সকালে দুই ভাই-ই গোসল করে নতুন জামা পরবে। ছোট ভাইয়ের বিয়ে তাই বড় ভাইয়ের আনন্দ বেশি। ছোট ভাইয়ের আগেই গোসল করে, নতুন রঙিন গেঞ্জি পরে বসে আছে। ছোট ভাই তৈরি হয়ে, যাত্রার শুরু জন্য বড় ভাইকে ডাকতে এসে দেখে, বড় ভাই গেঞ্জি পরেছে উল্টো করে। ছোট ভাই এ নিয়ে একটু হৈ চৈ করে বেরিয়ে যায়। কিন্তু বড় ভাই আর ঘর থেকে বের হয় না। সবাই এসে একে একে তাকে ডাকতে থাকে। কিন্তু বড় ভাইয়ের রাগ আর ভাঙে না। নিরুপায় হয়ে যখন সবাই শেষবারের মতো চেষ্টা করে বড় ভাইয়ের রাগ ভাঙাতে এবং রাগের কারণ জানতে। তখন বড় ভাই বলে ওঠে যারা সোজা করে গেঞ্জি পরেছে, তারাই যাক বিয়ে করতে। আমি যাব না।
আমাদের রাজনীতিবিদদের সবাই যে এখন এই বড় ভাইয়ের মতো রাগ করে বসে নেই, তার প্রমাণ বগুড়া বিএনপির তৃণমূল নেতাদের সংবাদ সম্মেলন। এমন করে শুধু পদের লোভে নয়, বরং প্রকৃত রাজনীতির চর্চার আগ্রহে যত বেশি বড় ভাইয়েরা মুখ খুলতে শুরু করবেন, ততই মঙ্গল।
লেখক: কবি, সাংবাদিক
ফারুক জোয়ারদার, মহাখালী ব/এ, ঢাকা