Published in Jaijaidin on Sunday, 13 July 2014.
টানা ব্যর্থতা: তবু উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য
আবু সাইম
বাস্তবতা উপলব্ধি করে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে বিশাল রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁট করা হয়। তবে সংশোধিত লক্ষ্য থেকেও আড়াই হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে থেকে বছর শেষ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে টানা দুই বছর ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ব্যর্থতার মাঝেও নতুন বছরে আবারো দেড় লাখ কোটি টাকা আদায়ের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এনবিআর। আর এ বিশাল টার্গেট অর্জনেও শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, গত বছরের শুরুতে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি রাজস্ব আদায় করা কথা এনবিআরের। পরে তা ১১ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু জুন শেষে এনবিআরের সাময়িক হিসেবে সংস্থাটি ১ লাখ সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করে। আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং আমদানি শুল্ক এই তিন বিভাগেই কোনোটিতেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। তবে মূল হিসেবে আদায় কিছুটা বাড়লেও লক্ষ্য পূরণ হবে না বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। এর জন্য অর্থবছরের মাঝামাঝিসহ বেশ বেশকিছু দিনের রাজনৈতিক অস্থিরতাকেই দায়ী করেন তারা।
তারা বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ ছিল। একই সঙ্গে বন্ধ ছিল পণ্য আমদানি ও রপ্তানি প্রক্রিয়া। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে।
২০১২-১৩ অর্থবছরেও এনবিআরকে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতিতে পড়তে হয়। ওই অর্থবছরে এক লাখ ১২ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল এক লাখ ৯ হাজার ৫১ কোটি টাকা। ঘাটতি ছিল তিন হাজার ২০৮ কোটি টাকা।
তবে ২০১১-১২ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। ওই বছর রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৯৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।
এদিকে গত অর্থবছরের রাজস্ব আদায় নিয়ে আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করে বিভিন্ন সংগঠন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশ্লেষণ বলা হয়, ২০১৩-১৪ অর্থবছর সরকারের রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ২৫.৩ শতাংশ। কিন্তু সরকার প্রথম দশ মাসে মাত্র ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা তাদের প্রাক্কলনের চেয়ে ১২ হাজার কোটি টাকা কম। লক্ষ্যমাত্রা কমানোর পরও বর্তমান প্রাক্কলনে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে শেষ দুই মাসে ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করতে হবে; যা কল্পনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। তবে শেষ পর্যন্ত রাজস্ব ঘাটতি চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো থেকেই যাবে ধারণ করেছিল সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতার মধ্যদিয়েও আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে বিশাল লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়। গত বছরের চেয়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আয়কর থেকে আসবে ৫৭ হাজার ৫০০ কোটি, ভ্যাট ৫৫ হাজার ৫৮০ কোটি ও শুল্ক থেকে ৩৬ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা।
তবে এ লক্ষ্যমাত্রাকে চ্যালেঞ্জিং বলছেন অর্থনীতিবিদসহ বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বব্যাংকও মনে করে রাজস্ব আয় বাড়ানোই হবে চ্যালেঞ্জের। তারা বলছে, রাজস্ব আয়ের ল্যমাত্রা ১৬.৮ শতাংশ ধরা হয়েছে। সেটি পূরণ করতে হলে কর নিট রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। অর্থনীতির আকার বাড়ার সঙ্গে কর বাড়াতে হবে। এ পর্যন্ত শুধুমাত্র ২০১১-১২ অর্থবছরেই লক্ষ্যমাত্রাকে পূরণ করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু আর্থিক খাতের দুর্বলতাগুলো এখনও রয়েছে। তাই তা চ্যালেঞ্জিং।
একই বক্তব্য বেসরকরি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)। তারা বলছে, বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে প্রাক্কলন করা হয়েছে বর্তমান বাস্তবতায় তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এছাড়া উন্নয়ন ব্যয়ের প্রাক্কলনও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। রাজস্ব আদায় সরকারের জন্য অনেকটা চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করে সিপিডি। সংস্থাটির মতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে এ ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তির সম্পৃক্তকরণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। তা না হলে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের আওতা বৃদ্ধি করতে হবে। ফলে আওতা বৃদ্ধি না করলে বিদ্যমান খাতগুলোতে করের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সরকার বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে। কিন্তু কীভাবে অতিরিক্ত কর আদায় করা হবে, তা স্পষ্ট করেনি। কর কমানো কিংবা বাড়ানোর বিভিন্ন প্রস্তাব বাজেটে থাকলেও এর ফলে কোন খাতে কত টাকা রাজস্ব আদায় কমবে কিংবা নতুন কর কী প্রভাব ফেলবে তার নির্দেশনা নেই।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ফাহমিদা খাতুন যায়যায়দিনকে বলেন, সরকার আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। গত অর্থবছরেও এনবিআর লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। এ বছর কীভাবে পারবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। দেশের অর্থনীতিতেও এমন কোনো উল্লম্ফন দেখা যায়নি যাতে এ বিশাল রাজস্ব আদায় করা সম্ভবপর হতে পারে। তাই এ লক্ষ্য আদায় সরকারের জন্য অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে।