With comments from Dr Debapriya Bhattacharya, published in Prothom Alo on Friday, 7 February 2014.
খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার মহোৎসব
মনজুর আহমেদ
রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল বা নিয়মিত করার মহোৎসব শুরু হয়েছে। কথা ছিল কেবল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা এই সুযোগ পাবেন। অথচ দেখা যাচ্ছে পুরোনো-নতুন প্রায় সব খেলাপিই তাঁদের ঋণ কোনো এককালীন জমা (ডাউন পেমেন্ট) ছাড়াই বা নামমাত্র জমা দিয়ে নিয়মিত করে নিচ্ছেন।
বিভিন্ন ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, একধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ব্যাংকগুলোতে এক মাসের বেশি সময় ধরে খেলাপি ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর হিড়িক লেগে আছে।
এই মহোৎসবে ব্যাংকগুলোও যোগ দিয়েছে। কারণ এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমবে এবং এভাবে খেলাপি ঋণ নিয়মিত হলে এর বিপরীতে প্রভিশনিং বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হবে না। ফলে মুনাফার পরিমাণ বাড়বে। তাতে ব্যাংকের উদ্যোক্তারা বেশি করে লভ্যাংশ পাবেন। একই সঙ্গে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ওপর যে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়, তা-ও লাগবে না বলে ব্যাংকের মূলধনের ভিত্তিও বাড়বে। সব মিলিয়ে ব্যাংকের স্বাস্থ্য কাগজে-কলমে ভালো দেখাবে।
ব্যাংকগুলোর প্রায় প্রতিটি পরিচালনা পর্ষদ সভাতেই নতুন ও পুরোনো খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলের বিপুল প্রস্তাব যাচ্ছে, সেগুলো পর্ষদ নতুন করে লম্বা সময় দিয়ে ঋণ পরিশোধের অনুমোদনও দিচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এককালীন জমা নেওয়ার বিধানটি মানা হচ্ছে না। আবার কোনো নগদ জমা করা ছাড়াই ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম দফায় যেগুলো পুনঃ তফসিলের প্রস্তাব আসছে, সেগুলোর অনুমোদন দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেবল প্রথম বা দ্বিতীয় দফায় পুনঃ তফসিল হয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে ১২ মাসের জন্য অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।
২০১৩ সালের শেষ দুই মাসে দেশের ভয়াবহ রাজনৈতিক সহিংস পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ে। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ী নেতাদের চাপে সরকার বিশেষ সুবিধা দেওয়ার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়। তবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নেতাদের চাপ ছিল ঋণ শ্রেণীকরণের যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১১ সাল থেকে অনুসরণ করছে, তা আপাতত স্থগিত রাখা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা না করে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্ক এবং প্রতিটি ঋণের ক্ষেত্রে পৃথক বিবেচনায় এককালীন জমার বিষয়টি শিথিল করে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলের সুযোগ দেয়। তার পরও নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত উল্লেখ করে এই সুযোগকে নানাভাবে কাজে লাগাচ্ছেন পুরোনো ও অভ্যাসগত খেলাপিরা।
তবে রাজনৈতিক সহিংসতায় যাঁরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁরা সরকারের দেওয়া সুযোগ তেমন পাচ্ছেন না বলে ব্যাংক সূত্রগুলো জানায়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি সমীক্ষা করে বলেছে, রাজনৈতিক সহিংসতায় কৃষি, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতের ক্ষুদ্র উৎপাদকেরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। রপ্তানিমুখী শিল্পের চেয়ে দেশীয় বাজারনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মনে করা হয়, রপ্তানিমুখী শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু আমাদের সমীক্ষায় প্রথমে এসেছে কৃষি ও কৃষিজাত খাত, রপ্তানিমুখী শিল্প তৃতীয় অবস্থানে। সরকার যদি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দিতে চায়, তাহলে কারা বেশি এই সহায়তা পাওয়ার যোগ্য, তা আমাদের বিশ্লেষণের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।’
পুরোনো খেলাপিরা: রাষ্ট্রীয় খাতের জনতা ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ের লিতুন ফেব্রিক্সের ইতিপূর্বে পুনঃতফসিল করা ৮২ কোটি ৯০ লাখ ৭০ হাজার টাকার বিভিন্ন ধরনের ঋণ ৭ শতাংশ সুদে নিয়মিত করার অনুমোদন দিয়েছে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত অপরিবর্তিত রেখে প্রথম কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে আগামী জুন পর্যন্ত করা হয়েছে।
লিতুন ফেব্রিক্সেরই নতুন খেলাপি ৫২ কোটি ১৯ লাখ ১৩ হাজার টাকার এবং অশ্রেণীকৃত ৪০ কোটি ৪১ লাখ ৭৩ হাজার টাকার বিভিন্ন ধরনের ঋণ একইভাবে এককালীন জমা ছাড়াই ৭ শতাংশ সুদে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত পুনঃতফসিল করার অনুমোদন দেয় পর্ষদ।
অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি গ্রাহক রূপগঞ্জ ট্রেডিং কোম্পানির সুদসহ মোট ৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকার ঋণ পরিচালনা পর্ষদ পুনঃতফসিলের অনুমোদন করেছে। এ ক্ষেত্রে আগের সুদের হার ১৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৬ শতাংশ নির্ধারণ এবং ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঋণগুলো পুনঃতফসিল করা হচ্ছে।
রূপালী ব্যাংকের খেলাপি প্রতিষ্ঠান মাররিন ভেজিটেবল অয়েলের মোট ১৭৩ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। এগুলোকে এখন মেয়াদি ঋণে পরিণত করে ১২টি সমান কিস্তি পরিশোধ করার কথা বলা হচ্ছে। এগুলো মন্দ মানের খেলাপি ছিল।
জনতা ব্যাংক পারটেক্স সুগার মিলের সিন্ডিকেশন ঋণের নেতৃত্বকারী ব্যাংক। প্রকল্প ঋণে ব্যাংকের অংশ ৯১ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং চলতি মূলধনের অংশ ১৫ কোটি টাকা। এই ঋণও পুনঃতফসিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংক। একইভাবে ন্যাশনাল ব্যাংকে (এনবিএল) মনোয়ার ট্রেডিংয়ের ১১৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকার ঋণ, জিএমজির ১৩৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকার ঋণ এবং মেরিন ভেজিটেবলের ৩০৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংক।
ব্যাংকের হঠাৎ উন্নতি: এনবিএলে বেক্সিমকো গ্রুপের বেক্সিমকো লিমিটেডের ১২৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, জনতা ব্যাংকে একই কোম্পানির ২৬৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা এবং রূপালী ব্যাংকে বেক্সিমকো লিমিটেডের ৪৩০ কোটি ৬৯ লাখ টাকার ঋণ গত বছরের শেষ ভাগে এসে পুনঃতফসিল করার জন্য ব্যাংকগুলোর পর্ষদ অনুমোদন করেছে। এর মধ্যে রূপালী ব্যাংক বেক্সিমকো লিমিটেডের ঋণ আগেও কয়েকবার পুনঃতফসিল করে দিয়েছে।
বড় বড় এই ঋণ নিয়মিত করায় ব্যাংকের আয়ও বেড়ে গেছে। সামগ্রিক খেলাপি ঋণ কমে গেছে। এনবিএলের একটি সূত্র জানায়, তাদের খেলাপি ঋণ ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ছিল দুই হাজার ৪২৭ কোটি টাকা বা বিতরণ করা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৬১ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে হয়েছে ৪৩২ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৫১ শতাংশ।
যোগাযোগ করা হলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) চলতি দায়িত্বে থাকা বদিউল আলম বলেন, ‘আমরা এককালীন জমা রেখে খেলাপি ঋণগুলো পুনঃতফসিল করছি। এতে খেলাপি ঋণ কমে গেছে।’
অন্যদিকে জনতা ব্যাংকের সূত্র জানায়, ডিসেম্বর শেষে তাদের খেলাপি ঋণ কমে ১০ শতাংশে মধ্যে নেমে এসেছে, সেপ্টেম্বর শেষে যা ছিল ১৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ব্যাংকের এমডি এস এম আমিনুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক একটা সুযোগ দিয়েছে, আমরা তার আওতায় প্রস্তাব পাঠিয়ে কিছু খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছি।’
তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ন্যূনতম ৫ শতাংশ এককালীন জমা নিয়ে পুনঃতফসিলের জন্য ব্যাংকগুলোকে বলছি। এই সুযোগের অপব্যবহার বা অপচয় করা হলে তা ব্যাংকের ভবিষ্যতের জন্য নেতিবাচক হবে। সেটা সব ব্যাংককেই মনে রাখা উচিত।’