Published in Arthoniti Protidin on Saturday, 1 February 2014.
বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান
আব্দুল হাই রঞ্জু
বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়ে, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। নির্মম হলেও সত্য, দেশে গত তিন মাসের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে ধস নেমেছে। বিনিয়োগ হ্রাসের কারণে বিগত তিন মাসে কমপক্ষে ৪০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট হয়েছে। বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর এই তিন মাসে মোট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ১০ কোটি মার্কিন ডলারের। অথচ আগের বছরে একই সময়ে বিনিয়োগ এসেছে ১১৫ কোটি মার্কিন ডলারের। এ প্রসঙ্গে বিনিয়োগ বোর্ড সূত্র জানায়, গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক পরিবেশ অবনতির কারণে শুধু বিনিয়োগ নয়, সব ক্ষেত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ বাস্তবতাকে স্বীকার করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, গত তিন মাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। পাশাপাশি এফডিআই প্রবাহও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে তিনি আশাবাদী, পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে আগামীতে এফডিআই বৃদ্ধি পাবে এবং বিনিয়োগ কর্মসংস্থানও বেড়ে যাবে।
দেশি বিনিয়োগ বন্ধ থাকায় ব্যাংকগুলোতে অলস অর্থের পরিমাণও অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ ডিসেম্বর ব্যাংকগুলোতে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ছয় লাখ ১২ হাজার ২৬৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এ ছাড়া গত ১৩ মাসে ব্যাংকগুলোতে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি আমানত বেড়েছে। মূলত বিনিয়োগ কমার কারণেই ব্যাংকের অলস টাকার পরিমাণ বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট এ কে আজাদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি শিল্প খাতে ১৮ শতাংশ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হলেও ব্যবহার হয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। তার মতে, বিনিয়োগ কমার কারণ শুধু রাজনৈতিক পরিস্থিতিই নয়, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটও অন্যতম কারণ। দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পূর্বশর্তই হচ্ছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের নিশ্চয়তা। অথচ দেশের বিদ্যুৎ ও গ্যাস পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও চাহিদার মোট বিদ্যুৎ ও গ্যাস এখনো হাতের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে। যেখানে বিদ্যুৎ ও গ্যাস কর্তৃপক্ষ চলমান চাহিদা পূরণে এখনো রেশনিং পদ্ধতিতেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের চাহিদা পূরণ করছে, সেখানে নতুন করে শিল্প স্থাপনে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ যে দিতে পারছে না, তা বলাই বাহুল্য। অথচ সরকার ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়ায় ঘটা করে আলোক উৎসব পালন করেছে। যদিও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা এখনো সম্ভব হয়নি। তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়, সরকার মোট চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যার সুফল পেতে হয়তো আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে, শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, নতুন শিল্প স্থাপনে গ্যাস-সংযোগ পেতে প্রধান ভরসা এখন ঘুষ। একটি শিল্প স্থাপনে গ্যাস সংযোগ দিতে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা ঘুষ গুনতে হয়।
সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) রাজধানীর ধানমন্ডির নিজস্ব কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশে অর্থনীতি ২০১৩-১৪ : দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা’ নামের প্রতিবেদন উপস্থাপন করে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে গত ছয় মাসে ৪৯ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে চারটি সুপারিশ তুলে ধরেছে সিপিডি। সংস্থাটির মতে, বর্তমান অবস্থায় অর্থনীতির ক্ষমতা বাড়িয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন ও কর্মসংস্থানের জন্য যথেষ্ট নয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে বেসরকারি বিনিয়োগও চাঙ্গা হবে না। এ অবস্থায় চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারের আয়-ব্যয়ের কাঠামো সংশোধন করতে হবে। কেননা চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ অর্থবছরে ১৮ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হবে। দ্বিতীয়ত, বোরো চাষ যেন সুষ্ঠুভাবে হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক সংঘাতের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত রফতানি খাত, কৃষি ও শিল্প খাতের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করতে হবে। চতুর্থত, সরকারের নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীদের অনিশ্চয়তা দূর হয়। সংস্থাটি দাবি করে, বর্তমানে দেশে সাড়ে নয় লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দুশ্চিন্তারও কারণ। খাদ্য মজুদের এ পরিমাণ গত বছরের তুলনায় ৩১ শতাংশ ও তার আগের বছরের তুলনায় ৩৮ শতাংশ কম। বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্যের মূল্য এখনো কম, ফলে আমদানি করে খাদ্যের মজুদ বৃদ্ধিরও পরামর্শ দেয় সংস্থাটি।
গত ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগবান্ধব সতর্ক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। নতুন এই মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগ চাঙ্গা রাখতে আস্থার পরিবেশ তৈরির জন্য রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) সুদহার কমানো এবং ঋণ পুনঃতফসিলে বিশেষ সুবিধা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে (এসএমই) ব্যাংকগুলো চলতি অর্থবছরের জন্য আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তবে ব্যাংকগুলোর বাড়তি সুদহার কমার বিষয়ে পূর্বের নীতিই ঠিক রেখেছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ধারণা ব্যাংকের সুদহার কমানো হলে সঞ্চয়কারীরা ক্ষতির মুখে পড়বে Ñ এ আশঙ্কায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো হস্তক্ষেপ করছে না। কোনো অবস্থাতেই এ ধরনের খোঁড়া যুক্তি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে না। বর্তমানে মাত্রাতিরিক্ত সুদহার ব্যাংকগুলোর মুনাফার জন্য অনুকূল হলেও শিল্প বিকাশের পথে বড় অন্তরায়, যা নিশ্চিত করেই বলা সম্ভব। আমরা জানি, শিল্পে বিকাশ ঘটলে কর্মসংস্থানও বাড়ে। আবার কর্মসংস্থান বাড়লে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়ে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষি ও শিল্পের উৎপাদনও বেড়ে যায়। বিষয়টি একে অপরের পরিপূরক। অথচ ব্যাংকগুলোর সুদহার ক্রমান্বয়েই বাড়ছে, আবার এর সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে সেবার নামে নানা ধরনের ফি। বাড়তি সুদহার শুধু বিনিয়োগ পরিস্থিতি নয়, বরং বাড়তি সুদের কারণে ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়ে। অবশ্যই বিনিয়োগের স্বার্থে বাড়তি সুদহার কমিয়ে আনার বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুনর্বিবেচনায় নেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।
এমনিতেই দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরেই মন্থর। এর ওপর অনেকটাই ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতোই যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থাকে ঘিরে বিরোধী জোটের সহিংস আন্দোলনের বলি হয়েছে দেশের গোটা অর্থনীতি। শেষ পর্যন্ত বিরোধী জোটসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইতোমধ্যেই নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। বিরোধী জোট অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে অনড় থাকলেও হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি থেকে বিরত রয়েছে। ফলে বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও অনিশ্চয়তা এখনো রয়েই গেছে। শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কোন অবস্থায় থাকবে, তা অবশ্য অনেকটাই নির্ভর করছে সরকারি দলের চিন্তা-চেতনার ওপর। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সরকারি দলের অনেকেই নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বললেও এখন তারা সে অবস্থান থেকে সরে এসে বলতে শুরু করেছে, সরকারের মেয়াদ পূর্র্ণ করেই একাদশ সংসদ নির্বাচন যথাসময়েই অনুষ্ঠিত হবে। হয়তো ক্ষমতাসীন হতে পারলেই ক্ষমতার মেয়াদ পূর্র্ণ করার আকাক্সক্ষা থাকাই স্বাভাবিক। তবে সরকারি দলকেও ভাবা উচিত, অধিকাংশ ভোটারের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়নি, এ ক্ষেত্রে একমাত্র আলোচনার পথেই সমঝোতা হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা সম্ভব। অন্যথায় রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলে আর যাই হোক, দেশের অর্থনীতির যে বারোটা বাজবে, তা অনেকটাই নিশ্চিত। অথচ নতুন এই সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই আস্থা ফিরিয়ে আনা। এ জন্য বিরোধী জোটের অহিংস গণতান্ত্রিক কর্মসূচিকে পালনের সুযোগও সরকারের দেওয়া উচিত। কারণ দাবি আদায়ের পথে ন্যূনতম সভা, সমাবেশ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। এ অধিকারকে খর্ব করে কোনো ক্ষমতাসীন জন-আস্থা ধরে রাখতে পারেনি। সর্বোপরি দেশের মানুষ চায় বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, অর্থনীতিতে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ন্যূনতম গ্যারান্টিটুকু। কোনোভাবেই যেন দীর্ঘমেয়াদে দেশি-বিদেশি নতুন বিনিয়োগে অনুকূল পরিবেশ বিঘিœত না হয়। স্মরণ রাখতে হবে, বিনিয়োগ কর্মসংস্থান সর্বোপরি অর্থনৈতিক উন্নয়নে অধিকতর গণতান্ত্রিক পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই।
বিনিয়োগ বোর্ডের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে মাত্র ১৩ হাজার ৮২৭ কোটি টাকার, যা গত বছরের একই সময়ের অর্ধেক। সূত্রমতে, দেশের প্রাথমিক বস্ত্র খাতে বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
এ খাতের উৎপাদনে যদি ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আনতে হয়, তাহলে অন্তত তিন হাজার কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগ প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে বিটিএমএর সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত বছর এ খাতে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে, যার মধ্যে নতুন বিনিয়োগ যৎসামান্যই। তিনি বলেন, শুধু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তার কারণেই কারখানা স্থাপন কিংবা আগের কারখানার সম্প্রসারণও হচ্ছে না। মূলত রাজনৈতিক সহিংসতা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতির কারণে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানের ওপর। অর্থনীতিবিদদের মতে, বিগত তিন মাসে নতুন কোনো কর্মসংস্থান তো সৃষ্টি হয়ইনি, বরং ছোটবড় বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে লোক ছাঁটাই শুরু হয়েছে। সম্প্রতি নতুন সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ব্যবসায়ীদের আস্থার সংকট দূর করে দেশকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে নিতে হবে। এ জন্য চাই বিরোধীদের আন্তরিক সহযোগিতা। যথাযথই বলেছেন, সরকারি দল, বিরোধী দল মিলেই দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। দেশবাসীও চায়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে সকলে এগিয়ে যাই। দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাবনাময় দেশ এখন বাংলাদেশ। সংকীর্ণ স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি, লুটপাট বন্ধ করে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানবান্ধব পরিবেশ রক্ষা করতে পারলেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। সকলকেই স্মরণ রাখতে হবে, সবার ঊর্ধ্বে দেশের স্বার্থ।
লেখক : কলামিস্ট