Published in Amader Shomoy on Saturday, 31 January 2015.
অব্যবস্থায় মড়া অর্থনীতির উপর খাঁড়ার ঘা
সাদেক খান
সংবাদপত্রে শীর্ষ শিরোনাম : পেট্রলবোমায় দগ্ধ দেশের অর্থনীতি। টানা ২৪ দিনের অবরোধ ও হরতালে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি সাড়ে ৫৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পাঁচটি খাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। পরিবহনে ৭ হাজার ২৪৮ কোটি, ক্ষুদ্র দোকানিদের ৭ হাজার ২শ কোটি, কৃষি খাতে ৬ হাজার ৯১২ কোটি, শিল্প খাতে ৫ হাজার ২৫৫ কোটি ও পোশাক খাতের ক্ষতি ৫ হাজার ১৬০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষতি চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
কিন্তু আদপেই কি পেট্রলবোমার কারণে দেশের অর্থনীতি দগ্ধাবস্থায় পতিত? নাকি আর্থরাজনৈতিক অব্যবস্থা ও দুঃশাসনের কারণেই লাগাতার অবরোধ-হরতালে মানুষ সাড়া দিচ্ছে? ৫ জানুয়ারি সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী বিএনপি কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল ২০-দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়াকে। সেখান থেকেই পাল্টা দেশব্যাপী টানা অবরোধের হুকুম দিয়েছিলেন তিনি। সেই টানা অবরোধের মধ্যে অকালমৃত্যুতে লাশ হয়ে দেশে ফিরেছে মামলা-হামলায় ৭ বছর নির্বাসিত তার কনিষ্ঠপুত্র আরাফাত রহমান কোকো। ২৭ জানুয়ারি কোকোর জানাজায় জনসমুদ্রের জোয়ার নিয়ে সাংবাদিক-বিশ্ববাণিজ্য সংলাপ বিশেষজ্ঞ মাহফুজউল্লাহ মন্তব্য করেছেন, আরাফাত রহমান কোকোর জানাজায় এত লোকের সমাগমের পেছনে দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বর্তমান শাসক শ্রেণি আওয়ামী লীগের প্রতি যে নিদারুণ ক্ষোভ রয়েছে, জনসমুদ্রই এর বহিঃপ্রকাশ। এর দ্বারা সরকারকে এই বার্তাই দেওয়া হচ্ছে যেÑ বিরোধী দলের সঙ্গে বর্তমান সরকার যে আচরণ করছে তা মোটেই সঠিক নয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে বিএনপির যে অনেক মৌন সমর্থন আছে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কোকোর জানাজার মধ্য দিয়ে।
এই মৌন জনসমাজ অর্থনৈতিক অব্যবস্থার জন্যও সরকারকেই দায়ী করছে। আর বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণেও একই কথা ফুটে উঠছে। সম্প্রতি সাংবাদিকদের কাছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ ব্যাখ্যা করেছেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বলেছেন, গত বছর প্রবৃদ্ধি কাক্সিক্ষত মাত্রায় হয়নি। বিনিয়োগ শ্লথ হয়ে গেছে। যদিও সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ছিল মোটামুটি স্থিতিশীল। গত বছর বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়েনি, রাজস্ব আয় কাক্সিক্ষত মাত্রায় হয়নি। বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার যে ৮৫ ভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে সেটা কতটা মানসম্মত ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
চলতি বছরে ছয় মাসে (২০১৪-১৫ জুলাই-ডিসেম্বর) রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে সাড়ে নয় ভাগ। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে হলে অর্থবছরের বাকি মাসগুলোয় রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হতে হবে গড়ে ৪০ শতাংশ, যা প্রায় অসম্ভব। চলতি অর্থবছর শেষে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি থাকবে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। দেশে ব্যক্তি খাতে উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগই হচ্ছে না। কিন্তু মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৪৩ শতাংশ। এর মধ্যে বেশিরভাগই হচ্ছে শূন্য শুল্কে আমদানি করা পণ্য। এ পণ্যগুলো সরাসরি বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণও নয়। পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়কালে ‘বেস মেটাল ও আর্টিক্যালস অব বেস মেটালের’ আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬০০ শতাংশ (৫৯৫%)। গত অর্থবছরে একই সময়ে যা ছিল মাত্র আট শতাংশ (৮%)। একই সময় ইলেকট্রিক্যাল পার্টস আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩৫ শতাংশ (১৩৫%)। গত অর্থবছরে একই সময়ে যা ছিল ৩৩ শতাংশ (৩৩%)। এখানে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে যে, কৌশলে এভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে।
একটি মার্কিন গবেষণা সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১২ সালে দেশ থেকে ১৪০ কোটি ডলার পাচার হয়ে গেছে। এর আগে ভারতীয় পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স আকারে ২০১৩ সালে ভারতে চলে গেছে ৩৭০ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশে বৈধ-অবৈধ কর্মজীবী ভারতীয়দের রেমিট্যান্স ছাড়াও চোরাচালানের মোটা টাকা পাচার হচ্ছে। একদিকে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে, অন্যদিকে তা বিদেশ ঘুরে বেসরকারি খাতে ঋণ দেখিয়ে দেশে নিয়ে আসা হচ্ছে। রপ্তানি ইনভয়েসের মাধ্যমে ভুয়া মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচার করা হচ্ছে। কোনো কোনো মহল থেকে আবার ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার দাবি জানানো হচ্ছে। তারা আফ্রিকাসহ অন্যান্য জায়গায় বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগের নামে মুদ্রা নিয়ে যায়।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তাতে অনেক বছর ধরে আমরা প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ঘরে রেখেছি। দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে ৮ থেকে ৯ শতাংশ হারে। আর সেটি তখনই সম্ভব যখন দেশে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হবে জিডিপির ২৮ থেকে ২৯ শতাংশ। বর্তমানে যা ১৮-১৯ শতাংশে রয়েছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না মূলত তিন কারণে। এক. বিদ্যুৎ, গ্যাস, জমি ও যোগাযোগের মতো ভৌত কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতার কারণে। দুই. সংস্কারের অভাব। তিন. রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা।
শুধু যে বেসরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে না তাই নয়, একই সঙ্গে সরকারি বিনিয়োগও হচ্ছে না। দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি। চলতি অর্থবছরে এ খাতে সরকার ৮০ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ করবে বলে প্রাক্কলন করেছে। কিন্তু অর্থবছরের ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২৮ শতাংশ। এডিপি যদি কাক্সিক্ষত মাত্রায় বাস্তবায়িত না হয় তবে তা দেশের কর্মসংস্থানের মাত্রার ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
এক কথায়, শেখ হাসিনার ‘ঐকমত্যের সরকার’ এমনই অব্যবস্থা ও অর্থলিপ্সু ভ্রষ্টাচারে নিমজ্জিত ছিল যে, গত এক বছরেই দেশের অর্থনীতি টাকা পাচার আর পুকুরচুরিতে বিধ্বস্ত হওয়ার উপক্রম। সেই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এসেছে টানা অবরোধের রাজনৈতিক অস্থিরতা। মুক্তির উপায় কী?
একুশ শতকের বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াধীন দ্রুত বিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থায় বহির্বাণিজ্য ও বৈদেশিক সহযোগিতা যে কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে বহুলাংশে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে যেখানে প্রবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ বিরাটভাবে রপ্তানি বাণিজ্য ও জনশক্তি রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল, সেখানে বৈদেশিক পর্যবেক্ষকদের ‘ধারণা’ অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গতিবেগ প্রভাবান্বিত না করে পারে না। বাংলাদেশের চলমান সংকট নিয়ে একজন মার্কিন বিশ্লেষকের নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি থেকে ‘মুক্তির উপায়’ সম্পর্কে প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত জবাব মিলতে পারে। তবে যুক্তি দিয়ে মুক্তি মিলবে কি না তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
ভয়েস অব আমেরিকার বেতারে সম্প্রচারিত একটি সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির গবেষণা প্রতিষ্ঠান হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের এশিয়ান স্টাডিজ সেন্টারের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো লিসা কার্টিজ বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংঘাত এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের অবরোধ গত বছর নির্বাচনের আগে যেমনটি ঘটেছিল তারই পুনরাবৃত্তি। মূলত এ অবস্থার জন্য দায়ী গত বছরের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন, যা অনুষ্ঠিত হয় বিরোধী রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়া। এখন বিরোধী দল অবরোধ ডেকেছে, সহিংস-বিক্ষোভ করছে আর সরকার হাজার হাজার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী আটক করছে।’
‘এটি অত্যন্ত ভয়ানক পরিস্থিতি এবং এর কারণে এখন ইসলামপন্থী জঙ্গিরা বর্তমান অবস্থার সুযোগ নিতে পারে। আল কায়েদা নেতা আয়মান আল জাওয়াহিরি গত বছর বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ফলে আল কায়েদার মতো জঙ্গি দল বা অপরাপর ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠন বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিতে পারে। এটি অত্যন্ত মারাত্মক পরিস্থিতি।’
‘প্রথমত, বুঝতে হবে যে ওই ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের কারণে বিরোধী রাজনৈতিক দল অসন্তুষ্ট। তবে সরকারের কাছে তাদের দাবি জানানোর পন্থা হিসেবে বিরোধী দলের এ অবরোধ কর্মসূচি সঠিক পন্থা নয়। দাবি আদায়ের জন্য তাদের অন্য পথ অবলম্বন করতে হবে। আর সরকারের উচিত গ্রেফতারকৃত বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তি দেওয়া। এর দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য সরকার ও বিরোধী দলকে সংলাপে বসতে হবে এবং সরকারকে অবশ্যই বিরোধী দলের দাবি স্বীকার করতে হবে।’
‘বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মুসলিম গণতান্ত্রিক অংশীদার, কিন্তু এখন এমন অবস্থা যে দেশটিতে একদলীয় শাসন চলছে এবং আমার মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা বিবেচনা করা উচিত এবং এমন একটা পথ খোঁজা উচিত যেখানে বিরোধী দল তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে। আপনি গণতন্ত্রের নাম দিয়ে একদলীয় শাসন বজায় রাখতে পারেন না।’
‘আমি মনে করি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ভালো অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, সম্পর্ক রয়েছে জাপানের সঙ্গে এবং অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গেও। তারা কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মতামত বিবেচনার পরামর্শ দিতে পারেন।’
‘আমার ধারণা চীন ও ভারতের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে তেমন সহযোগিতা আসবে না। (চীন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না।) ভারত বিশ্বাস করে সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকা-ে শেখ হাসিনা ভারতের স্বার্থ রক্ষার্থে ভালো সহযোগী। ফলে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা করতে ভারত শেখ হাসিনাকে চাপ দেবে তা মনে হয় না। তাই বর্তমান অবস্থা নিরসনের চেষ্টা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও কিছু ইউরোপিয়ান দেশ তাদের কূটনৈতিক প্রভাব কাজে লাগাতে পারে।’ বাড়তি মন্তব্য নি®প্রয়োজন।