Published in Alokito Bangladesh on Saturday, 24 January 2015.
ব্যবসা-বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা : রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কা
জিয়াদুল ইসলাম
স্বস্তির অর্থনীতিতে হঠাৎ হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে বিএনপি জোটের টানা হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি। এতে অর্থনীতির সব খাতেই নেমে আসছে চরম বিপর্যয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে তৈরি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তা। ফলে সরকারের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে রাজস্ব আহরণে ঘাটতি দেখা দিয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে রাজস্ব খাতে ঘাটতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। যা সামাল দিতে সরকারকে ব্যয় সঙ্কোচন নীতি গ্রহণ করতে হতে পারে। তখন উন্নয়নমূলক কর্মকা- বাস্তবায়ন বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না- এমন পূর্বাভাস দিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তারা চলতি অর্থবছর রাজস্ব আদায়ে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঘাটতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইও বলছে, রাজস্বের সিংহভাগই আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে উৎপাদন ও আমদানি-রফতানি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, যা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
চলতি অর্থবছরে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬০ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৫৮ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। ফলে এ সময়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম আদায় বা ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪ কোটি টাকা। যদিও এ সময়ে রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধির হার হয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জা এবি আজিজুল ইসলাম শুক্রবার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজস্ব আদায়ে বড় প্রভাব ফেলবে। এক্ষেত্রে রাজস্ব আহরণের সব খাত থেকেই আদায় কমে যাবে। যেমন আমদানি-রফতানি কমলে আমদানি শুল্ক বাবদ রাজস্ব আহরণ কম হবে। সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ভোগ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের বেচাবিক্রি কমে যাওয়ায় এ খাত থেকে মূল্য সংযোজন করও (ভ্যাট) কমে যাবে। আবার রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে বড় বড় প্রতিষ্ঠান ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ায় তারা সঠিক সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে এখান থেকেও করপোরেট ইনকাম ট্যাঙ্ বাবদ রাজস্ব কমবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতি হলে এর প্রভাব পড়বে স্বাভাবিকভাবেই রাজস্ব আদায়ের ওপর। খুচরা বিক্রি কমলে ভ্যাট আয় কমবে। বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের প্রফিট কমে যাবে। তখন এ খাত থেকে সরকারের করপোরেট ট্যাঙ্ কম হবে। তিনি আরও বলেন, রাজস্ব কমলে সরকারের ব্যয়ও কমাতে হতে পারে। তবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে এখানে তুলনামূলক ব্যয় কম হচ্ছে। মোটকথা বর্তমান পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে অর্থনৈতিক চাপে পড়বে সরকার। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলছেন, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব। তিনি বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের কৌশল হিসেবে এ সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেবে এনবিআর।
এদিকে, টানা অবরোধে দেশের অভ্যন্তরে কৃষি ও শিল্পপণ্যের সরবরাহ যেমন বিঘ্নিত হচ্ছে, তেমনি স্বাভাবিক আমদানি ও রফতানি কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। এতে থমকে যাচ্ছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। ফলে প্রতিদিনই ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। ঢাকা চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, ১৬ দিনের হরতাল-অবরোধে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩৬ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। যা জিডিপির ২.৬৯ শতাংশ। এর মধ্যে পোশাক রফতানি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এ সেক্টরের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১১ হাজার ১২০ কোটি টাকা। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৪ হাজার ৮০০ কোটি, কৃষি খাতে ৪ হাজার ৬০৯ কোটি, আবাসন খাতে ৪ হাজার কোটি, পর্যটন খাতে ৩ হাজার ৩৬০ কোটি, পাইকারি বাজার, শপিংমল, শোরুম, ক্ষুদ্র ও ছোট দোকানে ২ হাজার ৪০০ কোটি, উৎপাদন খাতে ১ হাজার ৬০০ কোটি, পোলট্রি খাতে ২৯২ কোটি, বীমা খাতে ২৪০ কোটি এবং হিমায়িত খাদ্যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৬ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা।
বিগত দুই অর্থবছরই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে পারেনি এনবিআর। গত অর্থবছরে মূল বাজেটে ঘোষিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধিত বাজেটে কমানো হয়েছে। এমনকি সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে আনার পরও ওই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়নি।