Published in Prothom Alo on Saturday, 20 June 2015.
জিডিপির হিসাব নিয়ে বিভ্রান্তি
অবরোধের ক্ষতির হিসাব জিডিপিতে নেই
জাহাঙ্গীর শাহ
চলতি অর্থবছরের তিন মাসের টানা হরতাল-অবরোধে পরিবহনব্যবস্থা প্রায় অচলই ছিল। সড়কপথে বাস-ট্রাক দেখা যায়নি বললেই চলে। পণ্য আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। দিনের পর দিন বাস-ট্রাক মালিক-শ্রমিকদের বসে থাকতে হয়েছে। গাড়ি মেরামতের ওয়ার্কশপগুলোও বন্ধ ছিল।
ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, ৪৪ দিনের হরতাল-অবরোধে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) হিসাবে উৎপাদন ক্ষতি ছিল ৪ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা এবং বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ক্ষতি আরেকটু বেশি, ১৭ হাজার কোটি টাকা। এসব হিসাব আমলে নিলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ক্ষতি হওয়ার কথা এক শতাংশ বা তারও বেশি। অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে বিদায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জিডিপি হয়েছে ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। অর্থাৎ হরতাল-অবরোধের কোনো প্রভাব জিডিপিতে নেই। বরং দেখা যাচ্ছে, হরতাল-অবরোধে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন খাতে এবার মূল্য সংযোজন কমেনি, বরং বেড়েছে। অর্থাৎ, পরিবহন খাতটি আগের বছরের চেয়ে বেশি চাঙা ছিল।
সড়ক, নৌ ও আকাশপথের পরিবহনকেই মূলত এ হিসাবে আনা হয়। এ ছাড়া পরিবহন খাতকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার ওয়ার্কশপ রয়েছে। খুচরা যন্ত্রপাতি বিক্রির জমজমাট ব্যবসাও হয়। এসব আনুষঙ্গিক সেবাকেও পরিবহন খাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জিডিপি গণনার সাময়িক হিসাবে দেখা গেছে, এত হরতাল-অবরোধের পরও পরিবহন খাতে আগের বছরের চেয়ে ৩ হাজার ৩৮২ কোটি টাকার বেশি মূল্য সংযোজন হয়েছে। চলতি অর্থবছরে পরিবহন খাত থেকে ৬৯ হাজার ১৪৪ কোটি টাকার মূল্য সংযোজন হয়েছে।
পরিবহন খাতে যে পরিমাণ সেবা সৃষ্টি হয়, এর ৮২ শতাংশের বেশি আসে বাস, ট্রাক, সিএনজি অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহন থেকে। হরতাল-অবরোধের ওই তিন মাস এসব যানবাহনের অধিকাংশই চলতে পারেনি। কিন্তু বিবিএস বলছে, সড়ক পরিবহনেই মূল্য সংযোজন বেড়েছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। এ বছর জিডিপিতে সড়ক পরিবহন থেকে ৫৬ হাজার ৯২০ কোটি টাকা এসেছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিবিএস হরতাল-অবরোধে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকার বিষয়টি জিডিপি গণনার সময় বিবেচনায় আনেনি। ২০০৯ সালের ‘বেসরকারি খাতে বাণিজ্যিক যান্ত্রিক যানবাহন সমীক্ষা’কে ভিত্তি ধরে কয়েক বছর ধরে পরিবহন খাতের জিডিপি গণনা করা হয়। সেই সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে বাস, ট্রাক, অটোরিকশা, মিনিবাস, টেম্পোসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন ছিল ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৮৭৫টি। এসব যানবাহন মাসে গড়ে ২১ থেকে ২৭ দিন চলে। ওই বছর ২৬ হাজার ১৩৩ কোটি টাকার মূল্য সংযোজন হয়েছিল।
প্রতিবছর কী পরিমাণ নতুন যানবাহন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ Ü(বিআরটিএ) থেকে নিবন্ধন নিয়েছে, সেই হিসাব নেয় বিবিএস। এর সঙ্গে মোট আগের যানবাহন সংখ্যার সঙ্গে যোগ করে বিবিএস। এর পাশাপাশি ভাড়া কী হারে বেড়েছে, তা বিবেচনা করে যানবাহন-প্রতি দৈনিক গড় মূল্য সংযোজনের নতুন হিসাব করা হয়। এভাবে তা বার্ষিক মূল্য সংযোজনে রূপান্তর করা হয়।
যে বছর অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে চলে, কোনো হরতাল-অবরোধ হয় না সেবার এভাবেই পরিবহন খাতের জিডিপি গণনা করা হয়। কিন্তু চলতি অর্থবছরের মতো তিন মাস হরতাল-অবরোধ হয়েছে, এমন বছরেও একইভাবে হিসাব করেছে। গত অর্থবছরেও করা হয়েছে। তাই হরতাল-অবরোধে যানবাহন চলাচল কার্যত বন্ধ থাকলেও তা জিডিপির হিসাবে আসেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিবিএসের জাতীয় হিসাব শাখার পরিচালক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, স্বাভাবিকভাবে অর্থনীতি চলেছে এমন অর্থবছরে এভাবেই জিডিপিতে পরিবহন খাতের অবদান হিসাব করা হয়। কিন্তু বছরের বিশাল সময় যানবাহন-ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ থাকলে কীভাবে তা হিসাব করা হবে, সেই কৌশল বিবিএসের নেই। কেননা ‘বেসরকারি খাতে বাণিজ্যিক যান্ত্রিক যানবাহন সমীক্ষা’র মতো খাতওয়ারি নমুনা সমীক্ষা ধরেই জিডিপি হিসাব করতে হয়। কয়েক বছর পরপর এ ধরনের নমুনা সমীক্ষা করা হয়। প্রতিবছর করা সম্ভবও নয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত প্রথম আলোকে বলেন, বিবিএসের পরিসংখ্যান ভিত্তি বেশ দুর্বল। পুরোনো ও নির্ধারিত কিছু মানদণ্ডের হিসাব করে বিবিএস। এতে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির চিত্র ওঠে আসে না। এর ফলে জিডিপি কিছুটা অতি প্রাক্কলিত হয়ে থাকে। তিনি মনে করেন, হরতাল-অবরোধে জিডিপিতে প্রতিদিন কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, এর ওপর বিবিএস বস্তুনিষ্ঠ সমীক্ষা করতে পারে। এ ধরনের সমীক্ষা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জিডিপি গণনায় সহায়তা করবে।
শুধু পরিবহন খাত নয়, হরতাল-অবরোধের প্রভাব পড়েনি হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায়। অথচ রাজনৈতিক এসব কর্মসূচির কারণে হোটেল, রেস্তোরাঁ ব্যবসায় ধস নেমেছিল। কক্সবাজারসহ পর্যটন এলাকায় হোটেলগুলোতে পর্যটকদের আনাগোনা ছিল না বললেই চলে। এ ছাড়া এ সময় রেস্তোরাঁ বন্ধ ছিল। কিন্তু বিবিএস বলছে, হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায় চলতি অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে ৩৮১ কোটি টাকার বেশি সেবা সৃষ্টি হয়েছে বা হবে। এ খাতের সেবার আর্থিক মূল্য ৫ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা।
হরতাল-অবরোধে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা এবং নির্মাণ খাতের ওপর প্রভাব পড়ার কথা। কিন্তু তা পড়েনি। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় বাড়তি সাত হাজার কোটি টাকা সেবা সৃষ্টি হবে বলে মনে করছে বিবিএস। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে সেবার আর্থিক মূল্য দাঁড়াবে ১ লাখ ১১ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
অন্যদিকে হরতাল-অবরোধে বহু নির্মাণকাজ বন্ধ থাকলেও জিডিপিতে তাও উঠে আসেনি। জিডিপিতে এ খাত থেকে আগের চেয়ে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বেশি মূল্য সংযোজন হতে যাচ্ছে।
মোটা দাগে, গত জানুয়ারি থেকে মার্চের টানা হরতাল-অবরোধে সেবা খাতই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু বিবিএসের হিসাবে, গত অর্থবছরের চেয়ে এবার সেবা খাতে ২৩ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকার বেশি মূল্য সংযোজন হবে। আর এতে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ হবে বলে সাময়িক হিসাব করেছে বিবিএস।
প্রতিবছর বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো দাতা সংস্থাগুলো বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কত হতে পারে, সেই পূর্বাভাস দেয়। কিন্তু বছর শেষে সেই পূর্বাভাসের সঙ্গে সরকারি হিসাবের গরমিল থাকে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জিত হবে না বলে আগেই বলেছে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ছিল, এ বছর ৫ দশমিক ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে। আর প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ১ শতাংশ হবে বলেছিল এডিবি। অন্যদিকে আইএমএফ বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৩ শতাংশ হবে।