Published in Jugantor on Sunday, 25 May 2014.
এডিপি বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা প্রকট
মামুন আব্দুল্লাহ
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে সরকারের সমন্বয়হীনতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এডিপি বাস্তবায়ন ও অর্থ ছাড় করার প্রক্রিয়ায় জড়িত সংস্থাগুলোর সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় না থাকায় একদিকে অর্থ ছাড়ে দেরি হচ্ছে, অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে। এতে কোনো বছরই পুরো এডিপি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এমনকী এডিপি দুই দফা সংশোধন করতে হচ্ছে।
গত ছয় বছরের এডিপি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোনো বছরই তা পুরো বাস্তবায়ন হয়নি। প্রতি বছরই দুই দফা সংশোধন করতে হয়েছে। অর্থবছরের শেষ দিকে এক দফা এবং পূর্ববর্তী অর্থবছরের হিসাব চূড়ান্ত করার সময় আরও এক দফা সংশোধন করতে হয়। নির্বাচনী বছর আসলেই কেবল এডিপি বাস্তবায়নের হার বাড়ে। এতে কাজের মান ভালো হয় না। বরং দুর্নীতি বাড়ে। আর বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় না থাকায় প্রকল্পে সারা বছরই জটিলতা লেগেই থাকে। গত ছয় বছরের এডিপির তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
স্বাধীনতার পর থেকে এডিপিতে বরাদ্দের আকার বেড়েছে। কিন্তু এডিপি বাস্তবায়নে সরকারের সক্ষমতা বাড়েনি। কয়েক বছর আগে সেন্টার পলিসি ফর ডায়ালগ (সিপিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের আয় করা সহজ, কিন্তু ব্যয় করা কঠিন। তাদের ভাষায় সরকার ১ টাকা আয় করতে পারলেও, ১ টাকা খরচ করতে পারে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব ভূইয়া সফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি আকার ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ হিসাবে উন্নয়ন বরাদ্দও বেড়েছে কয়েকগুণ। তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, প্রকল্প অনুমোদনে দেরি হওয়া, অর্থ সংকট ও বৈদেশিক সহায়তানির্ভর প্রকল্পে অর্থ ছাড়ে বিলম্বসহ বিভিন্ন কারণে এডিপি যথাযথ সময়ে বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, পুরোপুরি এডিপি কখনোই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ এডিপি একটা প্রজেকশন বা ধারণা মাত্র। এর আলোকে বাস্তবায়ন কাজ চলে। তবে আগের চেয়ে এডিপি বাস্তবায়নে সরকারের সক্ষমতা বেড়েছে। ফলে বাস্তবায়নেরও হারও বেশি।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) মূল বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে বছরের শেষ ভাগে ১০ শতাংশ কমিয়ে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয় ২৩ হাজার কোটি টাকা। ওই সময়ে মূল বরাদ্দ থেকে কমানো হয় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। তবুও বছর শেষে বরাদ্দের অর্থ পুরোপুরি ব্যয় করতে ব্যর্থ হয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও বিভাগগুলো। ওই বছর এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ৮৬ শতাংশ। তৃতীয় দফায় এডিপির আকার সংশোধন করতে হয়েছে। কেননা সংশোধিত এডিপির পুরো টাকাও খরচ করা সম্ভব হয়নি। ওই অর্থবছরে এডিপির প্রকৃত বাস্তবায়ন হয়েছে ১৯ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। যা মূল এডিপির চেয়ে ৫ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা কম। সংশোধিত এডিপির চেয়ে ৩ হাজার ২১৬ কোটি টাকা কম।
এডিপি বাস্তবায়ন কম হওয়ার নেপথ্যে অর্থ সংকট ও দাতাদের সহায়তা যথাসময়ে না পাওয়াকে দায়ী করেছেন বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো। তাদের মতে, বিশেষ করে বৈদেশিক সহায়তানির্ভর প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে দাতাদের অনেক শর্ত মানতে হয়। ওইসব শর্ত মানার বিষয়টি প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর নেই। ফলে প্রক্রিয়াগত জটিলতা লেগেই থাকে।
একইভাবে ২০০৯-১০ অর্থবছরে উন্নয়ন প্রকল্প খাতে সরকারের বরাদ্দ ছিল ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ বছরও বাস্তবায়নের হার সন্তোষজনক না হওয়ায় মূল বরাদ্দ থেকে ছেঁটে ফেলা হয় ৭ শতাংশ। এতে সংশোধিত এডিপির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। প্রথম দফায় মূল এডিপি থেকে ব্যয় কমানো হয় ২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষ হওয়ার পরবর্তী এক মাসেও মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ওই অর্থ ব্যয় করতে পারেনি। ফলে এডিপির বরাদ্দ আবার কাটছাঁট করতে হয়। ওই অর্থবছরে এডিপিতে মোট খরচ হয়েছে ২৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। ওই বছর সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৯১ শতাংশ। এ হিসাবে উন্নয়নে মোট সংশোধিত বরাদ্দের চেয়ে ২ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা কম খরচ করেছে। আর মূল বরাদ্দ থেকে ব্যয় কম হয়েছে ৪ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. এম কে মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, সারা বছর ধরে উন্নয়ন বরাদ্দের ব্যয়ে গতি থাকে না। এ জন্য বছর শেষে অর্থ ব্যয় করার হিড়িক পড়ে যায়। এ জন্য উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠে। মানহীন ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা। তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে অনুমোদন প্রক্রিয়া, অর্থ ছাড় ও প্রক্রিয়াগত ত্র“টি দূর করা জরুরি। তা না হলে গুণগত মানসম্পন্ন ও দুর্নীতিমুক্ত উন্নয়ন নিশ্চিত করা কঠিন হবে ।
২০১০-১১ অর্থবছরে মূল এডিপি ছিল ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের মন্থরগতি ও অর্থ সংকটের কারণে বছরের শেষ ভাগে এসে সংশোধন করতে হয়। এই দফায় মূল বরাদ্দ থেকে ৭ শতাংশ কমানো হয়। এতে বরাদ্দ ২ হাজার ৬২০ টাকা কমে দাঁড়ায় ৩৫ হাজার ৮৮০ কোটি টাকায়। ওই বছরে সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়ন হয় ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ সংশোধিত এডিপিও পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে উন্নয়নে সরকারের প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৩৩ হাজার ৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ সে বছর উন্নয়ন খাতে মূল বরাদ্দের থেকে ৫ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা কম এবং সংশোধিত বরাদ্দ থেকে ২ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা কম।
২০১১-১২ অর্থবছরে সরকার ৪৬ হাজার কোটি টাকার এডিপি ঘোষণা করে। ওই বছর অর্থ ছেঁটে ফেলার হারটাও ছিল বেশি। বছরের শেষ ভাগে এসে ১১ শতাংশ অর্থ ছেঁটে সংশোধিত এডিপি দাঁড়ায় ৪১ হাজার ৮০ কোটি টাকায়। প্রথম দফায় এডিপির আকার কমানো হয় ৪ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। বৈদেশিক সহায়তা লক্ষ্যমাত্রা অর্র্জিত না হওয়ার আশংকা ও অর্থ সংকটের কারণে এ সংশোধনী আনা হয় বলে জানা গেছে। বছর শেষে হিসাব সমন্বয় করে দেখা গেছে ওই অর্থও খরচ করা সম্ভব হয়নি। সে বছর উন্নয়ন প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয় হয় ৩৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৯৩ শতাংশ। এডিপির মূল বরাদ্দ থেকে প্রকৃত বাস্তবায়ন কম হয়েছে ৭ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা এবং সংশোধিত বরাদ্দের চেয়ে খরচ কম হয়েছে ২ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা।
গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫৫ হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন বাজেট ধরা হয়। সরকারের নির্বাচনী বছর হওয়ায় শুরু থেকেই অর্থ ব্যয় করতে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে। তারপরও রেকর্ড পরিমাণ এডিপি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে সংশোধিত এডিপিতে ৫ শতাংশ অর্থ ছেঁটে ফেলা হয়। এ হিসাবে এডিপির আকার ২ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা কমে দাঁড়ায় ৫২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা। ওই বছর সরকার ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় এডিপি বাস্তবায়নে হার দাঁড়ায় ৯৬ শতাংশ। আলোচ্য বছরে উন্নয়ন প্রকল্পে প্রকৃত পক্ষে ব্যয় হয় ৫০ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। যা মূল বরাদ্দের চেয়ে ৪ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা কম এবং সংশোধিত বরাদ্দের চেয়ে ২ হাজার ৯৫ কোটি টাকা কম।
চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বরাদ্দ যোগ করে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। বছরের শেষ দিকে এসে অর্থ সংকটের কারণে এখান থেকে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ছেঁটে ফেলার নির্দেশনা দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে বেঁকে বসে পরিকল্পনা বিভাগ। একের পর এক মিটিং করেও সমাধানে আসতে ব্যর্থ হয় দুই মন্ত্রণালয়। এক পর্যায়ে প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মোস্তফা কামাল। শেষ পর্যন্ত জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী পরিষদের (এনইসি) কমিটির বৈঠকে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ কমানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু চলতি বছরের ১০ মাসে (জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত) এডিপি বাস্তবায়নে হার মাত্র ৫৫ শতাংশ। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ ভাগ কম। আগের বছর একই সময়ে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ৫৬ শতাংশ। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরেও এডিপি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
আগামী বাজেট ঘোষণার আগে এক দফা এডিপি সংশোধন করা হবে। বরাদ্দ ৫ হাজার কোটি টাকা কমালে সংশোধিত বরাদ্দ দাঁড়াবে ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে কমছে প্রায় ৭ দশমিক ৭ শতাংশ।