Published in Jaijaidin on Sunday, 22 February 2015.
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা
অধরাই থাকছে কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি!
আবু সাইম
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে দেশের সার্বিক অর্থনীতি। গত দেড় মাসের অচলাবস্থার নেতিবাচক প্রভাবে ইতোমধ্যেই সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে দেশের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা। স্থবিরতা চলছে কৃষিসহ সব ধরনের সেবা খাতেও। তার ওপর রয়েছে বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ খরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে গত কয়েক বছরের মতো এ বছরও সরকারের কাঙ্ক্ষিত জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অধরাই থাকবে বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।
পাশাপাশি দেশি-বিদেশি গবেষণা সংস্থা, বিভিন্ন দাতা ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, এমনকি সরকারের কোনো কোনো সংস্থাও জিডিপি লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। চলমান অস্থিরতায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সরকারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
জানতে চাইলে ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, সরকারের ঘোষিত ৭ দশমিক ৩ শতাংশ জিডিপি অর্জন প্রশ্নাতীত (আউট অব কোয়েশেন)। বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাসে তা উঠে এসেছে। যা সরকারও উপলব্ধি করতে পেরেছে। অর্থমন্ত্রী নিজেও লক্ষ্যমাত্রা সংশোধনের কথা বলেছেন। দেশের অবস্থা স্বাভাবিক থাকলে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হতে পারতো। তবে বর্তমান অবস্থায় তা ৫ দশমিক ৫ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে তা অর্জন নিয়ে সরকারি মহলও দ্বিধাগ্রস্ত। অব্যাহত হরতাল-অবরোধ, অনিশ্চিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সার্বিক জিডিপি কাঙ্ক্ষিত অর্জন না হওয়ার শঙ্কাও তাদের মধ্যে। ইতোমধ্যে তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। উদ্বেগ থেকেই জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যামত্রা কমানোর কথাও বলছেন তিনি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, জিডিপির লক্ষ্যমাত্রাও কমাতে হবে। তবে তা এ মুহূর্তেই নয়। অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই সংশোধিত জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ নিয়ে হিসাব-নিকাশে নেমেছে বলে জানা গেছে।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে, দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট আরো ঘনীভূত হবে। একই সঙ্গে তা ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতেও কালো ছায়া ফেলবে। পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে দেশের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্নও ফিকে হয়ে আসবে।
এদিকে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সঙ্কট শুরুর আগেই শঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)সহ আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থা। অবার অভ্যন্তরীণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সহ বাংলাদেশ ব্যাংকও মনে করে জিডিপি ৭ শতাংশের নীচেই থাকবে। বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন মতে, বাংলাদেশের জিডিপি ৬ শতাংশ অর্জন করাও কঠিন হবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ধারণা করছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। সর্বশেষ মুদ্রানীতিতেও জিডিপির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬ দশমিক ৬ থেকে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। তাই বর্তমান অস্থির পরিবেশে প্রবৃদ্ধি আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছে সংস্থাগুলো।
বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত মতে, দেশে একদিনের অচলাবস্থায় জিডিপির ক্ষতি হয় দশমিক ১৭ শতাংশ। ৪৭ দিনে ক্ষতি দাঁড়িয়েছে জিডিপির ৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত দেড় মাসের সহিংসতা ও স্থবিরতায় জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন প্রায় স্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হাসান দৈনিক যায়যায়দিনকে বলেন, জিডিপি নিয়ে বিবিএস কি পদ্ধতিতে হিসেব করে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। ২০০৩ সালে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার পরও বিবিএসের হিসেবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপর ছিল। যা আগের বছরের দেশের স্বাভাবিক অবস্থার চেয়েও বেশি। এ বছরও গত অক্টোবরে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে পূর্বাভাস করা হয়েছিল, স্থিতিশীল অবস্থা থাকলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু গত দেড় মাস ধরে কৃষি, শিল্প, পরিবহন, আবাসন, ট্যুরিজমসহ সব খাতই বিপর্যস্ত। এ অবস্থায় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ অর্জন করাই কঠিন হবে। বিবিএসসের হিসেবে তা সর্বোচ্চ ৬.৪ বা ৬.৫ শতাংশ হলেও হতে পারে। তবে কোনো অবস্থায় তা সরকারের কাঙ্ক্ষিত ৭.৩ শতাংশে উন্নীত হওয়ার নয়। কেনা ৭ শতাংশের বেশি হওয়ার জন্য যে বিনিয়োগ প্রয়োজন তার সামান্যতমও নেই।
পরিবহন: জিডিপিতে পরিবহন খাতের অবদান শতকরা হিসাবে ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। টাকার হিসাবে এক লাখ ৩৬ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় পরিবহন খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। সব ধরনের পরিবহন প্রায় বন্ধ রয়েছে। মালিক সমিতির হিসাবে অবরোধ ও হরতালে একদিনে পরিবহনে ক্ষতি হচ্ছে ৩০২ কোটি টাকা। সে হিসেবে এ পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে ১৪ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।
ক্ষুদ্র ব্যবসা: জিডিপিতে পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্যের অবদান প্রায় এক লাখ ৭২ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। বর্তমানে সারাদেশে ২৫ লাখ ক্ষুদ্র দোকানপাট রয়েছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাবে প্রতিদিন হরতাল-অবরোধে ৩ হাজার কোটি টাকার লেনদেন স্থবির হয়ে পড়েছে। দিনে ৩শ কোটি টাকা হিসাবে ক্ষতি ছাড়িয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা।
কৃষি খাত: জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। বর্তমান অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক ও কৃষি খাত। ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে কৃষিপণ্য। একদিনের অচলাবস্থায় কৃষি খাতের ক্ষতি হচ্ছে ২৮৮ কোটি টাকা। সে হিসেবে এখন পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা।
শিল্প : জিডিপিতে বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প খাতের অবদান হচ্ছে ১৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ। টাকার হিসাবে ২ লাখ ২১ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। একদিনের অবরোধে শিল্পের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২১৯ কোটি টাকা। সে হিসেবে টানা অবরোধ ও হরতালের কারণে শিল্প খাতের ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
তৈরি পোশাক: এদিকে রপ্তানির বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে পোশাক শিল্পে অর্ডার প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। বিদেশি ক্রেতারা এ খাতের অর্ডার বাতিল করছে। জিডিপিতে তৈরি পোশাক খাতের অবদান প্রায় ১০ শতাংশ। টানা হরতাল-অবরোধ এ খাতের সুযোগ ও সম্ভাবনাগুলো নষ্ট হচ্ছে। ইতোমধ্যেই শিপমেন্ট ও রপ্তানি আদেশ বাতিলসহ এ খাতের ক্ষতি ২২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে জানা গেছে। যা এখাতের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিককে অনিশ্চয়তায় ফেলছে।
পর্যটন : এদিকে ভরা মৌসুমে দেশ পর্যটন শূন্য হয়ে পড়েছে। গত বৃহস্পতিবার এ খাত সংশ্লিষ্টদের এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় পর্যটন শিল্পে চলতি মৌসুমে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে এর সঙ্গে হোটেল মোটেলসহ অন্য সহযোগী খাত মিলে দিনে ক্ষতি দাঁড়ায় প্রায় ২০০ কোটি টাকা। সে হিসেবে গত দেড় মাসে ক্ষতি প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।