published in Shokaler Khobor on Saturday, 7 February 2015
ছাঁটা হচ্ছে অর্থনৈতিক সূচকের লক্ষমাত্রা
শাহ্জাহান সাজু
জানুয়ারি মাসের প্রথম থেকে টানা অবরোধ-হরতাল ও সহিংসতার কারণে শিল্প উত্পাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানিসহ অর্থনীতির সব খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যার প্রভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ, ব্যাংকঋণ, রাজস্ব আহরণসহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এসব কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আহরণ, বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (এডিপি) কমানো ও বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক সূচকের লক্ষ্যমাত্রা পুনঃনির্ধারণ করা হতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে বেসরকারি খাতও কঠিন সময় পার করছে। ব্যাংক-বীমা ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। রফতানি বাণিজের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্পের রফতানি লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হয়নি। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ওভেন খাতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কম হয়েছে ৫.০৯ শতাংশ, আর নিটওয়্যার খাতে আয় কমেছে ২.৯৪ শতাংশ। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বণিজ্য ঘাটতি। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েছে ১১৮ শতাংশ। আর সেবা বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েছে ২৬ শতাংশ। প্রবাসী আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গত ছয় মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও জানুয়ারি শেষে দাঁড়িয়েছে আট শতাংশ।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীও ইতোমধ্যেই বলেছেন, চলমান হরতাল-অবরোধ শুধু বাজেট নয়, সবকিছুর ওপরই এর প্রভাব পড়বে। এটা দেশের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। চলমান এ পরিস্থিতির কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমানো হবে। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের ৭ দশমিক ৩ শতাংশের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সেটা অর্জন করা যাবেই না, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তীতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সেটিও অর্জন করা যাবে না। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনীতির মূল সূচকগুলো পুনর্নির্ধারণের দরকার রয়েছে। কারণ দুর্বল অর্থব্যবস্থা, রাজস্ব আহরণ কম হওয়া এবং বৈদেশিক সাহায্য কম আসার কারণে এডিপি বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। এ কারণে রাজস্ব আহরণ ও বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তির আলোকেই এখন ব্যয় নির্বাহ করা দরকার। শুধু তাই নয়, আগামী বাজেটের বিষয়টিও এখন থেকে মাথায় রাখতে হবে। কারণ, সরকার ঘোষিত নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়ন হবে আগামী অর্থবছরের শুরু থেকে। সুতরাং সরকারি ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। এ অবস্থায় পে-স্কেল একবারেই পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হবে নাকি ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হব-সে বিষয়টিও ভাবার দরকার রয়েছে।
সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদে চলতি অধিবেশনেই ২০১৪-১৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের বাজেট বাস্তবায়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হতে পারে। এরপর অর্থবছরের সার্বিক বিষয়টি পর্যালোচনার কাজ শুরু করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরসহ ২০১৬-১৭ পর্যন্ত সময়ে মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর সূচকগুলোর প্রক্ষেপণের ওপর আলোচনা করা হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, চলতি অর্থবছরে প্রক্ষেপিত প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এ মুহূর্তে বিনিয়োগে আস্থা তৈরি করাসহ রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর হওয়া প্রয়োজন। যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে তাহলেই কেবল প্রবৃদ্ধির টার্গেট পূরণ হবে। আর যদি তা না থাকে তাহলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও বিনিয়োগ বাড়ানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধিসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সূচকের লক্ষ্যমাত্রা পুনর্নির্ধারণ করা হতে পারে বলে জানান তিনি।
এদিকে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় রাজস্ব আহরণেও পিছিয়ে পড়ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অন্যদিকে হরতাল-অবরোধের কারণে জানুয়ারি মাসে নির্মাণসামগ্রী পরিবহনে বাধা, কাজের তদারকির অভাব, ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের প্রকল্প এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের অভাবের কারণে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (এডিপি) বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
জানা যায়, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাত দশমিক তিন শতাংশ। তবে এ বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছয় দশমিক দুই শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে পরবর্তী বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে সাড়ে ছয় এবং সাত শতাংশে উন্নীত হতে পারে বলেও জানিয়েছে দাতা সংস্থাটি। গত অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ছয় দশমিক এক শতাংশ। সম্প্রতি ওয়াশিংটনস্থ প্রধান কার্যালয় প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘বিশ্ব অর্থনীতির পূর্বাভাস’ প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। আর চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছয় দশমিক ২৫ শতাংশে পৌঁছবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এ ছাড়া বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৪-১৫’ শীর্ষক অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনায় বলেছেন, বাজেটে চলতি অর্থবছরের জন্য সাত দশমিক তিন শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক তা কমিয়ে ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অর্থমন্ত্রী এ বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। কিন্তু ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনও চ্যালেঞ্জ হবে। তা অর্জন করতে হলে ২০ শতাংশ ব্যক্তি বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
একই অনুষ্ঠানে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, বর্তমানে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আছে জিডিপির ১৯ শতাংশের মতো। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এ বিনিয়োগ বাড়িয়ে ২৫ শতাংশে নিতে হবে।
অন্যদিকে, অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) এসে সরকারের বড় বিনিয়োগ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের গতি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী স্বাভাবিক থাকলেও হরতাল-অবরোধের কারণে জানুয়ারি থেকে তা ব্যাহত হচ্ছে। এ জন্য এডিপি বাস্তবায়নের গতি কমে আসার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে এডিপি বরাদ্দের ২৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বছরের শুরুতে ৮৬ হাজার কোটি টাকার এডিপি ঘোষণা করা হয়েছে। ছয় মাসে এডিপির ২৮ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ২৫ শতাংশ। তবে রাজস্ব আদায়ে পিছিয়ে পড়ছে এনবিআর। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ছয় মাসে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৬০ হাজার ৪৫৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে উল্লেখিত সময়ে ৫৮ হাজার ৪৪৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করতে সমর্থ হয়েছে এনবিআর। সে হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। আর সিপিডি বলেছে, প্রচলিত প্রতিবন্ধকতা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অভাব ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বছর শেষে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দাঁড়াবে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এসব কারণে প্রবৃদ্ধিসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক সূচকের লক্ষ্যমাত্রা পুনর্নির্ধারণ করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ সকালের খবরকে বলেন, হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে দেশের অর্থনীতিতে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। এ জন্য এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনের গতিশীলতা অব্যাহত রাখার স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধানের পথ বের করতে হবে বলে জানান তিনি।