Published in The Daily Sangram on Friday, 9 May 2014.
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন শান্তির পূর্বশর্ত
মানুষের মনের গহীনের বিপদের ভয়, আতঙ্ক, শঙ্কা, উদ্বেগ কাটানো সহজ কাজ নয়। রাজনীতি মানুষকে শান্তি দেয়ার জন্যই সরকার আর প্রশাসনের মাধ্যমে কাজ করে। কিন্তু বাস্তবে সেটা কতটুকু সম্ভব হয়? যদি নিয়মতান্ত্রিক ও আইনানুগ গণতান্ত্রিক শাসন হয়, তাহলে সেটা সামাজিক অন্যায় দূর করে মানুষকে শান্তি দিতে সচেষ্ট হলেও স্বৈরতন্ত্র বা অবৈধ শাসন সেটা সবসময় করতে পারে না। তখন ভীতির পরিবেশ এতটাই প্রলম্বিত হয় যে, মানুষ আতঙ্কে নীল হয়ে নিজের ঘরে বা সমাজে বসবাস করে। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, পৃথিবীতে এমন কোনো ওষুধ নেই, যা আপনাকে বিষণœতা ও উদ্বেগ থেকে মুক্তি দেবে। ওষুধ হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য আপনার মানসিক অবসাদ কমিয়ে রাখবে, কিন্তু কখনোই অবসাদ বা বিষণœতা বা উদ্বিগ্নতা থেকে পুরোপুরি মুক্তি দেবে না। বরং জীবনের সামান্য কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আপনার মানসিকতায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে, যা বিষণœতা প্রতিরোধে সহায়ক হবে।
কিন্তু বিষণœতা যদি হয় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে, তবে মুক্তি কোথায়? ফেসবুকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক এজিএম নিয়াজউদ্দিনের মুক্তির আর্তিটি এ রকমÑ “হে আল্লাহ, তুমি আমাদের গুম হওয়া থেকে রক্ষা কর। আমাদের সুস্থ, স্বাভাবিক এবং নিরাপদ জীবন দাও। আমিন!” নিয়াজ তরুণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। আরও লিখেছে, “একের পর এক গুম, হত্যা, লাশ… কী বীভৎস! সরকারি দলের হোক আর বিরোধী দলের হোক, এরাও তো মানুষ। এই দেশে সবারই নাগরিক হিসেবে বাস করার অধিকার আছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে তার জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা, কিন্তু কিছুদিন পরপর আমরা লাশের সন্ধান পাচ্ছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি বিশেষ গ্রুপের দিকেই যাচ্ছে। একটি রাষ্ট্র এভাবে চলতে পারে না। এই গুম, হত্যা যদি রাষ্ট্রের নির্দেশে কোনো বিশেষ বাহিনীর সহযোগিতায় হয়ে থাকে, তবে এই মুহূর্ত থেকে বন্ধের দাবি জানাই। আর যদি শামীম ওসমানের মতো কোনো গডফাদারের নির্দেশে হয়ে থাকে, তবে তার বিচার চাই। ইতোমধ্যে নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারদলীয় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাত রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। যে বা যারাই করুক না কেন, আমরা এর বিচার চাই। কেউ যদি ভয়ে এখন কথা না বলেন, তবে একদিন আমি-আপনি গুম হলেও কেউ কথা বলার থাকবে না। যেভাবে চলছে, এখন কে কখন গুম হবেন তার কোনো গ্যারান্টি নেই। আসুন সোচ্চার হই এবং এইসব গুম, হত্যার বিরুদ্ধে সবাই রুখে দাঁড়াই।” প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল নাগরিক সমাজ। কিন্তু গুম-অপহরণের প্রতিবাদে বিশিষ্ট নাগরিকদের মানববন্ধনে বাধা দিয়েছে পুলিশ। বাধা উপেক্ষা করে সংক্ষিপ্ত পরিসরে তারা কর্মসূচি পালন করেছেন। রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি নামে উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের এই মানববন্ধনের আগ মুহূর্তে পুলিশ গিয়ে বাধা দেয়। এর আগেই মানিক মিয়া এভিনিউয়ে একাধিক জলকামান ও রায়ট কার প্রদক্ষিণ করতে দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ সেখানে গিয়ে সমাবেশের ব্যানার, ফেস্টুন ও লিফলেট কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে। মাইক কেড়ে নেয়। যে রিকশায় মাইক লাগানো ছিল ওই রিকশার চালককেও আটক করে। এ সময় বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে পুলিশের বাগবিত-া হয়। এর মধ্যেই সংক্ষিপ্ত পরিসরে কর্মসূচি শেষ করা হয়। এ সময় বক্তারা বলেন, সারা দেশে গুম, অপহরণ হত্যা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত। আমাদের এই শঙ্কা জানাতেই এই সমাবেশের আয়োজন করেছি। এতেও যে পুলিশ বাধা দিয়েছে, তার প্রতি আমরা ধিক্কার জানাই। আমাদের শেষ মৌলিক অধিকারটুকু সঙ্কুচিত হতে চলেছে। যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানো নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সেই অধিকারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাধা সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে না। সাংবিধানিক অধিকার কীভাবে খর্ব করা হয়, তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে। সরকার নিজেদের নিজেরাই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের আজ বাধা দিয়ে সরকার গুম, খুনকারীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। তাদের মদদ দিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে, পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, “তারা সমাজের উচ্চ শ্রেণীর নাগরিক। তারা আইনের শাসনের কথা বলেন। অথচ তারাই সংসদ ভবনের মতো একটি সংরক্ষিত এলাকায় স্পিকার বা ডিএমপি কমিশনারের অনুমতি ছাড়া মানববন্ধন ও সমাবেশ করছিলেন।”
ফেসবুকে নিয়াজউদ্দীনের উদ্বেগের মতো শত শত উৎকণ্ঠিত মন্তব্য পাওয়া গেছে। নাগরিক সমাজের এক বা একাধিক প্রতিবাদও লক্ষ্য করা গেছে। বিএনপির মতো প্রধান রাজনৈতিক দল অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ উপায়ে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেছে গণঅনশন কর্মসূচির মাধ্যমে। এমনকি মানবাধিকার কমিশনের পক্ষেও উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, সরষের ভেতরেই ভূত রয়েছে। আগে সেই ভূতটিকে চিহ্নিত করুন। ‘চাটুকারদের’ কাছ থেকে দূরে থাকতে প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেন তিনি। বরগুনায় মানবাধিকার কর্মী সমাবেশ উদ্বোধনকালে তিনি দেশের বর্তমান অবস্থা ‘চরম ভীতিকর’ উল্লেখ করে বলেন, আমরা অনেক আগেই আপত্তি তুলেছি, সাদা পোশাকে যেন কাউকে আটক করা না হয়। এখন অবস্থা যখন ভীতির পর্যায়ে চলে গেল, তখন প্রজ্ঞাপন করে সাদা পোশাকে কোনো অভিযান না চালাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমি মনে করি, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এই পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। কোনো অভিযোগে কাউকে গ্রেফতার বা আটক করতে হলে অবশ্যই পোশাক পরিহিত অবস্থায় এবং সংশ্লিষ্ট বাহিনীর পরিচয়পত্র (আইডি কার্ড) দেখাতে হবে। এমনকি যাকে গ্রেফতার বা আটক করা হবে, অবশ্যই সেই এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাক্ষী রেখে আটক করতে হবে। এটা নিশ্চিত করা হলে দেশে খুন, গুম, অপহরণের এই ভয়ানক অবস্থা অনেকাংশে কমে যাবে। ড. মিজানুর বলেন, এরকম একটি বিষয় নিয়ে যদি শুধু রাজনৈতিক খেলা চলতে থাকে, তাহলে কিšুÍ সমস্যার উত্তরণ সম্ভব হবে না। পারস্পরিক দোষারোপ সমস্যার সমাধান নয়। মানুষ অপহৃত হচ্ছে, গুম হচ্ছে, নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুব একটা দৃশ্যমান হচ্ছে না। আটক বাণিজ্য চলছে। এসব বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আহ্বান জানান তিনি। জানি না, এসব আহ্বান ও আর্তি নিকট-অতীতের মতোই অরণ্যের রোদনে পরিণত হবে কিনা! হলে, মানুষের উদ্বেগ আর বিপদ মুক্তির পথও অচেনা আর অধরাই থেকে যাবে। আর তাহলে ঘোরতর মানসিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-আইনশৃঙ্খলাগত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-বিপদের অতল গহ্বরের মধ্যেই বাধ্য হয়ে বসবাস করতে হবে বাংলাদেশের মানুষকে।
যে কথা শুরুতেই বলা হয়েছে যে, শাসনের সমস্যা দেখা দিলে সেটা কুপ্রভাবও দেখা যায়। বাংলাদেশে এখন যে নিত্য গুম-হত্যা হচ্ছে, সেটা কিসের কুপ্রভাব? সিপিডি বলছে, আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। না হলে অস্বস্তি ও নিশ্চয়তা কাটবে না। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এমন মত দিয়ে বলেছে, পরিস্থিতি শান্ত হলেও অনিশ্চয়তার জন্য স্বস্তি ও আস্থার পরিবেশ ফিরে আসেনি। অর্থনীতিতে যতটা প্রাণ সঞ্চার হওয়ার কথা তা-ও হচ্ছে না। যার ফলে রাজস্ব আদায় কম হচ্ছে। ব্যক্তি বিনিয়োগ কম হচ্ছে। এডিপি বাস্তবায়নও কমে গেছে। রেমিট্যান্স আসার হার কমেছে। অনেকে বলেছিলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত হলে স্বস্তি আসবে। কিন্তু এই মুহূর্তে স্থবিরতা রয়ে গেছে। নতুন করে সম্পদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ব্যক্তি জীবনে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যেটি বিনিয়োগের জন্য নেতিবাচক। আসন্ন বাজেটের ওপর প্রস্তাব ও সুপারিশ প্রদান উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সংস্থাটির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বাজটের বিষয়ে তিনি বলেন, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ আর্থিক কাঠামোর বাজেট চাই। আসন্ন বাজেটের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আর্থিক কাঠামোয় বিশ্বাসযোগ্যতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা ও সক্ষমতা আনার বিষয় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে জানান তিনি। সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষক ড. হামিদা খাতুন। সভাপতিত্ব করেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
সিপিডির সঙ্গে একমত হয়েও বলতে হয়, যেখানে মানুষের জীবন ও জীবনযাপনের ক্ষেত্রেই ঘোরতর নিরাপত্তাহীনতা বিরাজমান, সেখানে বিনিয়োগের নিরাপত্তা বজায় রাখা কতটুকু সম্ভব হবে? নারায়াণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের খুন-হত্যা-গুমের ঘটনার পর মানুষ স্বাভাবিক জীবন ও ব্যবসা-বাণিজ্য কতটুকু পরিচালনা করতে পারবে? রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সন্ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতার কবল থেকে প্রথমে মানুষকে মুক্ত করা দরকার। এ কাজটি করতে হবে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কমিটমেন্টের মাধ্যমে। সিপিডি ও অপরাপর সংস্থার পক্ষে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকেই জোর দেয়া হয়েছে। সেটাই দূর করতে পারবে ‘সরষের ভূত’ এবং ফিরিয়ে আনতে পারবে শৃঙ্খলা-নিরাপত্তা-শান্তি।