Published in Jugantor on Sunday, 9 August 2015.
রাজনৈতিক অস্থিরতার বছরে বিনিয়োগ কমেছে
মনির হোসেন
রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলেই দেশে বিনিয়োগ কমে। একই সঙ্গে কর্মসংস্থান ব্যবস্থা সংকুচিত হয়। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাডের সর্বশেষ রিপোর্টে ওঠে এসেছে চিত্র।
দেখা গেছে, ২০০৫ সাল পর্যন্ত দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল। ২০০৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু হয় অস্থিরতা। ফলে পরের বছর ২০০৭ সালে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে দেখানো হয়, ২০০৬ সালে দেশে বিনিয়োগের জন্য ১ হাজার ৯০৫টি প্রকল্প নিবন্ধন হয়। সেখানে ৩১৩ কোটি ২ লাখ ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এর ফলে ৪ লাখ ৩ হাজার ৫১২ জনের কর্মসংস্থান হবে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে জরুরি অবস্থা জারি হয়। ওই সময়ে ১ হাজার ৪৮২টি প্রকল্প নিবন্ধিত হয়। এসব প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৯২ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। এ হিসাবে আলোচ্য সময়ে বিনিয়োগ কমেছে ৩৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আর কর্মসংস্থান কমেছে ২২ দশমিক ৮১ শতাংশ। কর্মসংস্থান আগের বছরের তুলনায় ৩ লাখ ১১ হাজার ৪৩৮ জন কমেছে।
২০০৮ সালেও দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। এ সময়ে বিনিয়োগ আরও কমেছে। আগের বছরের তুলনায় ২০০৮ সালে বিনিয়োগ কমেছে ১৭ শতাংশ এবং কর্মসংস্থান কমেছে ২৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের বিনিয়োগ ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতায় পুঁজি হারানোর আশংকায় নতুন করে বিনিয়োগ করতে চান না উদ্যোক্তারা। আর এ সময়ে পুঁজি পাচারেরও আশংকা থাকে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগের জন্য সবার আগে অনুকূল পরিবেশ জরুরি। বিনিয়োগকারীদের নিশ্চয়তা দিতে হবে, পণ্য উৎপাদনের পর তা বিপণন এবং পরিবহনে কেউ বাধা দেবে না। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে এগুলো বাধাগ্রস্ত হয়। এই অর্থনীতিবিদের মতে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য নিয়মিত কিছু সমস্যা রয়েছে। অবকাঠামো সমস্যা অন্যতম। যেমন গ্যাস-বিদ্যুতের স্বল্পতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি এবং ঋণের উচ্চ সুদ রয়েছে। এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। এরপর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকলে পুরোপরিবেশই বিনিয়োগের প্রতিকূলে চলে যায়।
আঙ্কটাডের রিপোর্টে দেখা গেছে, নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে পরের তিন বছর (২০০৯-১২) বিনিয়োগ বেড়েছিল। আবার ২০১২ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। একই সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র অস্থির হয়ে উঠে দেশের রাজনীতি। কমতে থাকে বিনিয়োগ। ২০১১ সালে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৬৯৭ কোটি ডলার। ২০১২ সালে তা কমে ৬০৮ কোটি ডলারে নেমে আসে। এ সময়ে বিনিয়োগ কমেছে ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এছাড়া ৩ লাখ ৬২ হাজার থেকে কর্মসংস্থান কমে ৩ লাখ ৮ হাজারে নেমে আসে। অর্থাৎ কর্মসংস্থান ১৭ দশমিক ৫২ শতাংশ কমেছে।
পর্যায়ক্রমে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ক্রমেই অস্থির হয় রাজনীতি অঙ্গন। যার প্রভাব পড়েছে দেশের বিনিয়োগে। ২০১৩ সালে বিনিয়োগ আরও কমে ৫৪৪ কোটি ডলারে নেমে আসে। আর কর্মসংস্থান কমে ১ লাখ ৭৮ হাজারে নেমে আসে। অর্থাৎ কর্মসংস্থান কমেছে ৪২ দশমিক ০৮ শতাংশ।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক প্রেসিডেন্ট কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতংক থাকে। ফলে ঝুঁকি নিয়ে কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণায় দেখানো হয়েছে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির অর্জনের জন্য মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৪ শতাংশ বিনিয়োগ জরুরি। চলতি অর্থবছরে জিডিপির আকার ১৭ লাখ ১৬ হাজার ৭শ কোটি টাকা। এ হিসেবে দেশে মোট ৫ লাখ ৮৩ হাজার ৬৭৮ টাকার বিনিয়োগ জরুরি। কিন্তু বর্তমানে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ২৮ শতাংশ।
ওই সংস্থা ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বেসরকারি বিনিয়োগের বিকল্প নেই। কিন্তু তিন কারণে বিনিয়োগ হয় না।