Published in Kaler Kantho on Monday, 16 March 2015.
বাজেট ঘাটতি বাড়াবে রাজনৈতিক অস্থিরতা
আবুল কাশেম
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় চলতি অর্থবছরের বাকি সাড়ে তিন মাস পার করা সম্ভব হলেও নতুন অর্থবছরের ব্যয় নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে সরকার। বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি নতুন অর্থবছরে সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নে বিপুল অর্থের দরকার হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতার নেতিবাচক প্রভাব ওই সময়ে বেশি হারে ভোগাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে। ফলে ব্যয় মেটানোর মতো রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনা দেখছেন না অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তাই বাধ্য হয়ে হয় বেশি করে ঋণ নেওয়ার পথ বেছে নিতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয়কে, না হয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যয় কমাতে হবে। আর এর যেকোনো একটি হলেই তার ক্ষতিকর প্রভাব হবে আরো মারাত্মক। বাজেট ঘাটতি বাড়বে অস্বাভাবিক হারে। তাই রাজনৈতিক অস্থিরতা এভাবে চলতে থাকলে সব দিক দিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়বে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। শ্লথ হয়ে যাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণত রাজস্ব আয় থেকেই সরকারের সারা বছরের ব্যয় মেটানোর কথা। কিন্তু ব্যয়ের চেয়ে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ যখন কম হয়, তখন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন উৎস থেকে সরকারকে ঋণ নিয়ে সেই ব্যয় মেটাতে হয়। এটাই বাজেট ঘাটতি হিসেবে পরিচিত। সাধারণ দৃষ্টিতে বাজেট ঘাটতির নেতিবাচক ফল বলতে কেবল সরকারের ঋণগ্রস্ত হওয়া মনে হলেও দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে এর বহুমুখী নেতিবাচক দিক রয়েছে। সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে যায়। ফলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও কমে যায়। আবার সরকার, সঞ্চয়পত্রের সুদ হার বাড়িয়ে সেখান থেকে বেশি অর্থ ঋণ নিলে ভবিষ্যৎ বাজেট ঘাটতি আরো বাড়ার আশঙ্কা থাকে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঘাটতি মেটানো হলে বাজারে অর্থের প্রবাহ বেড়ে যায়। তখন জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। এ জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হয় জনগণকে। আর রাজস্ব আয় যতই কম হোক না কেন, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় কমানোর সুযোগ নেই। অতীতে নেওয়া দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ কমানো বা ঋণ পরিশোধ না করারও সুযোগ থাকে না। তাই বাজেট ঘাটতি কমানোর জন্য শেষ পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ব্যয় কমানোটাই একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায় অর্থমন্ত্রীদের সামনে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আবার বেসরকারি খাতের ওপর। কারণ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সরকারের বিনিয়োগ কমে গেলে, অর্থাৎ বিদ্যুৎ, জ্বালানি, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা থাকলে বেসরকারি খাতও বিনিয়োগ করতে আগ্রহ হারায়। ফলে সবদিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অর্থনীতি।
গত মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম অর্থবছরে (২০০৯-১০) এক লাখ ১৩ হাজার ৮১৫ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পাঁচ বছর পর বাজেটের আকার দাঁড়ায় আড়াই লাখ কোটি টাকারও বেশি। আর শেষ বাজেটের ঘাটতির পরিমাণ পাঁচ বছর আগের মূল বাজেটের অর্ধেক, তবু বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যেই সীমিত থাকবে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় রাজস্ব আদায় বাড়ায় গত অর্থবছর পর্যন্ত বাজেট ঘাটতি নিরাপদ সীমানার মধ্যেই থেকেছে, যদিও প্রতিবারই খৰ পড়েছে এডিপির ওপর। তবে বাজেট বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক ঋণদাতা গোষ্ঠীর কাছে হাত পাততে হয়নি দেশকে। এমনকি পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পও নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের পথে পা বাড়ানোর সাহস জুগিয়েছে রাজস্ব আয়ের উল্লম্ফন। চলতি বাজেটের প্রথম ছয় মাসও (জুলাই-ডিসেম্বর) একই রকম স্বস্তিতে পার করেছে সরকার। তবে জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতায় চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বেশ দুরূহই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ফলে উন্নয়ন ব্যয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা কমানো হলেও ঘাটতির মাত্রা আগের অর্থবছরগুলোর তুলনায় বেশ বাড়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা। আর নতুন অর্থবছরে তা আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চলতি অর্থবছরের বাকি আর মোটে সাড়ে তিন মাস। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় সরকারের ভর্তুকিও বেশ কমেছে। তাই রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি মেনেও কোনো রকমে সময়টা পার করা যাবে। কিন্তু সমঝোতা না হলে এই অস্থিরতার কুপ্রভাব পড়বে আগামী অর্থবছরজুড়েই। রাজনৈতিক ঘূর্ণিপাকে পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। নতুন বিনিয়োগ ও উৎপাদনে স্থবিরতা দেখা দেবে। তাই নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আদায় কম হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। সঙ্গে ব্যয় বাড়বে। শুধু সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নেই অতিরিক্ত দরকার হবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল নির্মাণসহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বেশ কয়েকটি বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নে নতুন অর্থবছরে সরকারের আরো বেশি অর্থের দরকার হবে। কিন্তু এসব অর্থের সংস্থান করার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। কারণ দেশের রাজস্ব আয়ের ৯০ শতাংশই আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতায় সেই খাতেরই ত্রাহি অবস্থা। তাই এসব অর্থের সংস্থান করতে অর্থমন্ত্রীকে হাত পাততে হবে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণের দিকে। এতে মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। ফলে কয়েক বছর ধরে নিয়ন্ত্রিত গতিতে এগিয়ে চলা অর্থনীতি অনেকটাই গতিহীন হয়ে পড়বে।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশে রাখার কথা ছিল। পরে উন্নয়ন বাজেটে কাটছাঁট করে সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি ৪.৪ শতাংশে রাখার কথা বলা হয়েছিল। অর্থবছর শেষে ঘাটতি দাঁড়িয়েছিল জিডিপির ৩.৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছর দুই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪.৪ শতাংশ। এরই মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা থেকে রাজস্ব আদায়ের ব্যবধান বাড়তে শুরু করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব মতে, চলতি অর্থবছর এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সাত (জুলাই-জানুয়ারি) মাসে আদায় হয়েছে ৬৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে সরকারের রাজস্ব আদায়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকতে পারে বলে মনে করছে এনবিআর। আরেক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে, অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ২৫ হাজার কোটি টাকা।
অবশ্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আশা প্রকাশ করে বলেছেন, অর্থবছরের শেষ দিকে সাধারণত রাজস্ব আহরণ বাড়ে। তা সত্ত্বেও রাজস্ব ঘাটতি যাতে না বাড়ে সে জন্য বাড়তি তৎপরতা দরকার বলে মনে করেন তিনি। এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমানও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের প্রধান সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চলমান অস্থিরতার প্রভাব এখন যতটা দেখা যাচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে তা আরো প্রকট হবে। কারণ গত স্থিতিশীল রাজনৈতিক সময়ে যেসব রপ্তানি অর্ডার ছিল, তা এখন রপ্তানি করছি আমরা। কিন্তু আগামী পাঁচ-ছয় মাসের জন্য অর্ডার আসতে শুরু করে গত জানুয়ারি থেকে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে এই অর্ডার ৩০ শতাংশ কমে গেছে। শতকরা ৯৯ ভাগ বিদেশি ক্রেতা বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছে। রপ্তানিকারকদের মতো অন্য ব্যবসায়ীদের অবস্থাও একই রকম। তাই এখনই রাজনৈতিক সমঝোতা হলেও যে ক্ষতি হয়ে গেছে, তার প্রভাব দূর হতে কমপক্ষে বছরখানেক লাগবে।’
তবু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে এবং বিশ্ব অর্থনীতির ওপর থেকে মন্দার প্রভাব আরো কেটে যাবে-এমন প্রত্যাশা সামনে রেখে প্রায় দুই লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন করার কথা ভাবছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এটি চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি। রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে এত বড় বাজেট নিয়ে তা বাস্তবায়ন করার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ও লোক দেখানোর জন্য বড় আকারের বাজেট দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেই বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। চলতি অর্থবছরেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হওয়ার সম্ভবনা নেই। রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে আগামীতে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি আরো নাজুক হবে। কারণ সরকারের রাজস্ব আয়ের সিংহভাগই দিয়ে থাকে বেসরকারি খাত। কিন্তু চলমান হরতাল-অবরোধে বেসরকারি খাতের কর্মকাণ্ড প্রচণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। ফলে তারা রাজস্ব ছাড় পাওয়ার পাশাপাশি সরকারের কাছ থেকে নানা ধরনের প্রণোদনা চাইবে। ফলে রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়বে। তাতে বিপুল ঘাটতি দেখা দেবে।’
তিনি বলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে রেখেই দুই লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরে ৫ থেকে ৫.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হতে পারে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দুই লাখ ৬৫ হাজার থেকে দুই লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি বাজেট প্রণয়ন করা যৌক্তিক হবে না।
তবে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল থাকবে-এমন ভেবে ছোট বাজেট দেওয়ার পক্ষে নন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজস্ব আয়ের পরিমাণ নির্ভর করে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগবান্ধব পরিস্থিতি নিশ্চিত না হলে গত কয়েক বছর ধরে রাজস্ব আদায়ে যে প্রবৃদ্ধির ধারা রয়েছে, তা ব্যাহত হবে। তাতে বাজেট ঘাটতিও বাড়বে। আর বাজেট ঘাটতি গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি হলে তখন সরকারকে বাধ্য হয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যয় কমাতে হবে। আর অবকাঠামোগত খাতে সরকারের বিনিয়োগ কমলে শিল্প খাতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও কমে যায়। তখন অর্থনীতি একপ্রকার নিস্তেজ হয়ে পড়ে।’