Published in Bhorer Kagoj on Wednesday, 10 June 2015.
রপ্তানিতে উৎসে কর বৃদ্ধি : প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের
ওবায়দুর রহমান
প্রস্তাবিত বাজেট রপ্তানিতে উৎসে কর বাড়ানোর কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন রপ্তানিকারকরা। বিশেষ করে শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প উদ্যোক্তারা অর্থমন্ত্রীর এমন প্রস্তাবে চরম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তারা আশা করছেন বাজেট পাসের সময় এ প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হবে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, গত এক বছরে দেশের পোশাকশিল্প নানামুখী প্রতিক‚লতার সঙ্গে পথ চলছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে এ কর রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা কমিয়ে দেবে। যার ফলশ্রæতিতে সরকারের রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অনেকে বলছেন, এমন সিদ্ধান্তের ফলে অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে এ শিল্প। আবার ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে এমন সিদ্ধান্ত বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন অনেকে।
গত ৪ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তুলে ধরেছেন, তাতে তৈরি পোশাক পণ্যের রপ্তানি মূল্যের ওপর আরোপিত বর্তমান দশমিক ৩০ শতাংশ উৎসে কর বাড়ানোর কথা বলা হয়। অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, আমাদের কাপড় এবং পোশাকশিল্প নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করে। এ ছাড়া আরো রপ্তানি দ্রব্যও এই সুযোগ পায়। এই সুযোগটি শুধু এক বছরের জন্য দেয়া হয়েছিল। তাই এবার এই সুযোগ প্রত্যাহার করে তৈরি পোশাক, টেরি টাওয়েল, কার্টন ও এক্সেসরিজ, পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত মাছসহ সব রপ্তানি পণ্যের মূল্যের ওপর ১ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনের প্রস্তাব করছি এবং একই সঙ্গে ওই কর সব ক্ষেত্রে করদাতার চূড়ান্ত করদায় হিসেবে গণ্য করার প্রস্তাব করছি।
অর্থমন্ত্রীর এমন প্রস্তাবের প্রেক্ষাপটে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল খাত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। এই পরিস্থিতিতে কোনো অনভিপ্রেত সিদ্ধান্ত নেয়া হলে রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎসটি বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই বাজেটে রপ্তানিমুখী পোশাক ও বস্ত্র খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মন্তব্য করে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, বাজেট প্রস্তাবে সব প্রকার রপ্তানি মূল্যের ওপর উৎসে কর দশমিক ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে, অর্থাৎ এক ধাপে ২৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে এই শিল্পের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করবে।
এ খাত সংশিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজা ধসের পর দেশের পোশাক কারখানায় সংস্কারকাজ চলমান রয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতা জোটের চাহিদা অনুযায়ী মাঝারিমানের একটি কারখানা সংস্কার করতে গড়ে ৫ কোটি টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। অ্যাকর্ডভুক্ত ৬৭০টি কারখানা, অ্যালায়েন্সভুক্ত ১১০টি কারখানা এবং আইএলওর আওতাধীন ২৬২টি পোশাক কারখানার সর্বমোট ব্যয় হবে ১৪ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। ২০১৩-এর তুলনায় ২০১৫-তে মজুরি খরচ বেড়েছে ১৫ শতাংশ এবং বিভিন্ন কারণে ২০১৩-এর তুলনায় ২০১৫-এ শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১০ শতাংশ। বেড়েছে ব্যবসা পরিচালন ব্যয়। সেই অনুপাতে বাড়েনি পণ্যের বিক্রয় মূল্য। এর পর রয়েছে ইউরোর দরপতন। ইউরোর বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ১৯ দশমিক ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। গত অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। যা এ শিল্পকে প্রভাবিত করছে। একই সময়ে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো অনেক ভালো প্রবৃদ্ধি করছে। এ সময় পাকিস্তানের জিএসপি প্লাস প্রাপ্তির সঙ্গে ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, ফিলিপাইনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে টিপিপি টুক্তি স্বাক্ষর বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে আরো প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই পরিস্থিতে নতুন করে এ খাতে করের বোঝা বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত শিল্পের সক্ষমতায় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন শিল্প উদ্যোক্তারা।
এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে এ শিল্প। এ সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী নয় বলে মনে করেন বিজিএমইএর সাবেক এ সভাপতি। বিটিএমএ সভাপতি তপন চৌধুরী বলেন, সরকার আশির দশক থেকে বস্ত্র খাতে প্রণোদনা দিয়ে আসছে ঠিকই। কিন্তু তার বিনিময়ে এই খাত বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। দেশে কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। আমরা কর দিতে চাই না- তা ঠিক নয়, তবে আমাদের টিকে থাকারও সুযোগ দিতে হবে। বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান বলেন, আমাদের বিক্রি কমে গেছে, আবার দামও কমেছে। এদিকে শ্রমিকদের জন্য একটি তহবিল গঠন করতে হয়েছে, যেখানে দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ হারে অর্থ জমা করতে হবে। অ্যাকর্ড, অ্যাল্যায়েন্সের কারণে খরচ বাড়ছে। সবগুলো একবারে চাপিয়ে দিলে পারব না। বিজিপিএমইএ সভাপতি রাফেজ আলম চৌধুরীও বলেন, এই উৎসে কর দুইবার করে দিতে হচ্ছে। সুতা, কাপড় কেনা পর্যায়েও একবার দিতে হয়। সরকার বিষয়টি নিশ্চই বিবেচনা করতে পারে।
তবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে সিপিডি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) উৎসে কর বাড়ানোর সরকারের সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক বলে মত দিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, চলতি অর্থবছরে (২০১৪-১৫) অন্তর্বর্তীকালীন সহায়তার অংশ হিসেবে উৎসে কর হার কমানো হয়েছিল। আগামী অর্থবছরে তা আগের চেয়ে সামান্য বাড়ানো প্রস্তাবটি সঠিক।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে পোশাকশিল্পের জন্য যেসব সুবিধা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো রপ্তানির বিপরীতে ৭ শতাংশ ঋণ। দেশের অন্য কোনো খাত এই সুদে ঋণ পায় না, এমনকি এর দ্বিগুণ সুদ দিয়েও ঋণ পাওয়া কঠিন। এ ছাড়া রয়েছে ইডিএফ থেকে বিদেশি মুদ্রায় ঋণ নেয়ার সুবিধা। সরকার এই তহবিলটির পরিমাণ বাড়িয়ে এখন ২ বিলিয়ন ডলার করেছে। নগদ সহায়তা রয়েছে ৫ শতাংশ। যদিও এই নগদ সহায়তা তৈরি পোশাকশিল্প সরাসরি পায় না; পায় তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প (টেক্সটাইল, প্যাকেজিং, প্রিন্টিং ইত্যাদি)। বাজেটে এই খাতের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিং উপকরণ আমদানিতে ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু অন্য খাতের উদ্যোক্তারা এসব পণ্য আমদানি করলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। সর্বশেষ সরকার তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের ‘এক্সপোর্টার রিটেনশন’ কোটা (ইআরকিউ) ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে।