Published in Samakal on Thursday, 24 July 2014.
জামদানি বাংলাদেশের মালিকানা ভারতের!
রাজীব আহাম্মদ
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জামদানির আদি এবং মূল ধারণা বাংলাদেশের। ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব পণ্য সংরক্ষণে দীর্ঘদিন কোনো আইন না থাকায় তার মালিকানা চলে যাচ্ছে ভারতের হাতে।
২০০০ সালে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (ডবি্লউটিও) সদস্য দেশগুলোকে নিজস্ব পণ্যের তালিকা প্রণয়ন এবং মেধাস্বত্ব (পেটেন্ট) আইন প্রণয়নের নির্দেশনা দেয়। এরপর ২০০১ সালে জামদানির মালিকানা দাবি করে ভারত ডবি্লউটিওর কাছে আবেদন করে। বাংলাদেশের বোধোদয় হয়েছে এক যুগ বিলম্বে। ডবি্লউটিওর নির্দেশনা অনুযায়ী নিজস্ব পণ্যগুলোর মালিকানা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার গত বছর নিজস্ব পণ্যের মালিকানা সুরক্ষায় ‘ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) আইন-২০১৩’ প্রণয়ন করেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আইনটিতে অনেক দুর্বলতা রয়েছে এবং বিধিমালার অভাবে আইনটি কার্যকর করা যাচ্ছে না।
জামদানির মতো বাংলাদেশের ফজলি আম এবং শীতল পাটিরও মালিকানা দাবি করে আবেদন করেছে ভারত। ভারত মালিকানা পেয়ে গেলে বাংলাদেশ জামদানিকে আর নিজস্ব পণ্য বলে দাবি করতে পারবে না। ব্যবসায়িকভাবে লোকসানে পড়বেন বাংলাদেশের জামদানি ব্যবসায়ীরা।
একে একে বিভিন্ন নিজস্ব পণ্যের মালিকানা হাতছাড়া হলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মালিকানা ফিরে পেতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন প্রবর্তনার নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার। জামদানির ওপর বাংলাদেশি মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করতে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছেন ফরিদা আখতার ও তার প্রতিষ্ঠান।
তিনি সমকালকে বলেন, ঐতিহাসিকভাবেই জামদানি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য। ঢাকা এবং কিশোরগঞ্জ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও জামদানি তৈরি হয় না। অথচ ভারত জামদানির মালিকানা নিয়ে যাচ্ছে। তিনি জানান, বাংলাদেশ বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার (ডবি্লওআইপিও) কাছে ভারতের আবেদনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করার কারণে এমনটি হয়েছে।
এখনও জামদানির মালিকানা বাংলাদেশের ফিরে পাওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন ফরিদা আখতার। তিনি সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ইউনেস্কো এবং ডবি্লউআইপিও’র কাছে আবেদন করার মাধ্যমে মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, খ্রিস্টের জন্মের ৩০০ বছর আগে থেকেই বাংলাদেশে জামদানি উৎপাদিত হচ্ছে। পরে ৩০০ খ্রিস্টাব্দে রচিত কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ থেকেও জামদানির বর্ণনা পাওয়া যায়। নবম শতাব্দীতে আরব ভূগোলবিদ সোলায়মান তার ‘সিল সিলাই-উত-তওয়ারিখ’ গ্রন্থে জামদানির উল্লেখ করেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশ পরিভ্রমণ করেন এবং তার ভ্রমণকাহিনীতে সোনারগাঁওয়ের সুতিবস্ত্রের প্রশংসা করেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে ইংরেজ পর্যটক র্যালফ ফিচ ও ঐতিহাসিক আবুল ফজলও জামদানির প্রশংসা করে লিখেছেন।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি জামদানির ওপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে। ‘বাংলাদেশের জামদানি সংরক্ষণে ভৌগোলিক নির্দেশক’ শীর্ষক এই গবেষণায় বাংলাদেশের জামদানির মালিকানা ভারতের হাতে চলে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ‘ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) আইন-২০১৩’-এর ত্রুটিও এতে চিহ্নিত করা হয়।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের মালিকানা বিশ্ববাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভৌগোলিক নির্দেশক-জিআই মানে হচ্ছে, একটি বিশেষ প্রতীক
যার দ্বারা কোনো পণ্য বা সেবার উৎপত্তিস্থান, গুণাগুণ, সুনাম ও মালিকানার পরিচয় বহন করে।
সিপিডির গবেষণায় দেখা গেছে, হারিয়ে যাওয়া বিশ্ববিখ্যাত মসলিন জাতীয় পণ্য জামদানি। জামদানি বলতে হাতে তৈরি ঢাকার বিশেষ এই পণ্যকেই বোঝায়। যাতে ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে ঢাকার নাম চলে আসে। ঢাকার জামদানির সুতা এবং তৈরি করা জামদানি অন্যান্য দেশের জামদানি থেকে আলাদা।
ইতিহাসের এই অকাট্য দলিলগুলোই প্রমাণ করে জামদানি বাংলাদেশের একান্ত নিজস্ব পণ্য। তবু এর মালিকানা কী করে ভারতের কাছে চলে যাচ্ছে_ এ প্রশ্নের উত্তরে গবেষণাপত্রটি প্রণয়নকারী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ইফতেখার ইকবাল সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের উদাসীনতার সুযোগটিই নিয়েছে ভারত। ডবি্লউটিওর নির্দেশনার পর আইন করতে লেগেছে ১২ বছর। আইন করলেও বিধিমালার অভাবে মালিকানা দাবি করার মতো অবস্থা এখনও বাংলাদেশের আসেনি।
জামদানিগবেষক ড. ইফতেখার ইকবাল বলেন, প্রথমে জাতীয়ভাবে নিজস্ব পণ্যের তালিকা করতে হবে। জাতীয়ভাবে অনুমোদনের পর পেটেন্টের জন্য ডবি্লউটিওর কাছে আবেদন করতে হবে। ভারত আবেদন করলেও, জামদানি যে একান্তই বাংলাদেশের তা ডবি্লউটিওতে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণের সুযোগ রয়েছে। তার জন্য বাংলাদেশকে এখন থেকেই প্রস্তুত হতে হবে। এর জন্য দ্রুত বিধিমালা প্রণয়ন এবং ভারতের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে নিজস্ব মালিকানা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক সঞ্চিতা হক বলেন, বাংলাদেশি পণ্যকে ভারতের মালিকানা নিবন্ধনের বিরুদ্ধে দিলি্ল মিশনের মাধ্যমে সে দেশের সরকারের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত বিধিমালা হলে সব মিশনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা হবে।