Dr Khondaker Golam Moazzem on Bangladesh’s competitiveness

Published in Bonik Barta on Sunday, 5 July 2015.

গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা
আত্মতুষ্টিতে আড়াল হচ্ছে অর্থনীতির অনেক দুর্বলতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

 

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। ৬ শতাংশের উপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। এসব নিয়ে এক ধরনের আত্মতুষ্টি রয়েছে নীতিনির্ধারণী মহলে। কিন্তু আড়ালেই থেকে যাচ্ছে সমাজে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি, সুশাসনের অভাব, শিক্ষার নিম্নমান, অবকাঠামো দুর্বলতা ও উন্নয়নকাজে গুণগত মানের সংকটসহ অর্থনীতির অনেক দুর্বলতা।

গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ‘আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত ও এবারের বাজেট’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এ অভিমত ব্যক্ত করেন আলোচকরা। শেয়ারবাজার বিষয়ক ম্যাগাজিন মার্কেট পালস ও বণিক বার্তার যৌথ আয়োজনে এ আলোচনায় অংশ নেন দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সম্মানীয় অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। আলোচক হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, আইএলওর এমপ্লয়মেন্ট সেক্টরের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা ড. রিজওয়ানুল ইসলাম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক ড. ম. তামিম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ও সিএসইর বর্তমান চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম (সিনিয়র সচিব), ফিনএক্সেল লিমিটেডের চেয়ারম্যান মামুন রশীদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাখাওয়াত হোসেন ও ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্ল্যানিং এডিটর আসজাদুল কিবরিয়া।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন লংকাবাংলা ফিন্যান্সের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ মইন, লংকাবাংলা ফিন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন চৌধুরী, লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খায়রুল আনাম চৌধুরী, লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের সিটিও ও মার্কেট পালসের এডিটর ইনচার্জ মো. মাইনুল ইসলাম প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মনজুর হোসেন। এতে বাজেটের বিভিন্ন দুর্বলতা তুলে ধরেন তিনি।

ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজেটকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে বিবেচনা করতে গেলে যেসব বিষয় আসে তা হলো— বাণিজ্য অর্থাত্ আমদানি-রফতানি, প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) ও এফডিআই-বহির্ভূত অর্থ লেনদেন এবং রেমিট্যান্স। রফতানির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজার বড় হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এ বাজারে আমাদের রফতানি কী হারে বাড়ছে, তা বিবেচনায় নিতে হবে। গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানি বেড়েছে। কিন্তু একই সময়ে সে বাজারে বাংলাদেশের রফতানি কমেছে। রফতানি বহুমুখীকরণের বিষয়ে কোনো জোর দেয়া হচ্ছে না।

আমদানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেক কম। এতে বাংলাদেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টটা ভালো অবস্থানে থাকবে। পাশাপাশি আরো একটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। তা হলো আমাদের রেমিট্যান্স আসে জ্বালানি তেল রফতানিকারক দেশগুলো থেকে। তেলের দাম কমার প্রভাব রেমিট্যান্সে কেমন পড়ে, সেটাও দেখার বিষয়। তাই নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান জরুরি। আমরা বছরে দেড় হাজার কোটি ডলার রেমিট্যান্স আয় করছি। একই সময়ে বিদেশীরা এখান থেকে ৪০০ কোটি ডলার নিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশে মাথাপিছু রেমিট্যান্স বিশ্বে সবচেয়ে কম। এটি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে বাজেটে কিছুটা উদ্যোগ আছে বলে মন্তব্য করেন ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভারত, চীন ও জাপানের জন্য পৃথক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। এ উদ্যোগ কতটা সফল হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ে না। কিন্তু বর্তমানে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে, অন্যদিকে বেসরকারি বিনিয়োগ আনুপাতিক হারে কমছে। পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও দুর্নীতিমুক্ত না হলেও কম দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন।

সুষম উন্নয়ন ও আয়বৈষম্য কমানোর ওপর জোর দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সুষম উন্নয়ন ও আয়বৈষম্য কমানো বাজেটের একটি লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু তা হচ্ছে না। নতুন নতুন দরিদ্র মানুষ তৈরি হচ্ছে; কিন্তু তাদের জন্য কী করা হচ্ছে? শুধু প্রবৃদ্ধি বাড়ানো নিয়েই সবাই ব্যস্ত। আয়বৈষম্যের বিষয়ে কোনো কথা নেই।

বাজেটে রফতানি বহুমুখীকরণের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, বর্তমানে গ্রিসে যে মন্দা দেখা দিয়েছে, তা অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে কিনা। পাশাপাশি এমন পরিস্থিতিতে আমাদের রফতানি কতটা প্রভাবিত হতে পারে, সেসব বিষয় ভাবতে হবে।

রেমিট্যান্স বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর বলেন, রেমিট্যান্স আসছে ঠিকই। তার বেশির ভাগই ব্যয় হচ্ছে ভোগে। পাশাপাশি এর মাধ্যমেও আয়বৈষম্য বাড়ছে। কেউ ২ হাজার টাকা দিয়ে ইলিশ মাছ কিনে খাচ্ছে। আবার অনেকে সপ্তাহে একদিনও মাংস খেতে পারছে না।

শুধু নীতি প্রণয়ন করলেই হবে না, নীতি বাস্তবায়নে একটি কৌশলগত দূরদৃষ্টিও থাকতে হবে— এ মন্তব্য করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। এক্ষেত্রে শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, শিক্ষার মান দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মাধ্যমিক স্তরে। ফলে দক্ষতা অর্জনে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। সব ক্ষেত্রেই দক্ষতার অভাব রয়েছে।

তার মতে, বাজেট বক্তৃতায় অনেক ভালো কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু বাস্তব কর্মকৌশল নির্ধারণের সময় তার তেমন কোনো গুরুত্ব থাকে না।

কৃষির বিষয়ে তিনি বলেন, কৃষিকে এখন শুধু খাদ্যের জোগানদাতা খাত হিসেবেই দেখা হয়। কয়েক বছর ধরে কৃষিতে প্রবৃদ্ধি কমছে। কৃষির বহুমুখীকরণের বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। কৃষির বিপণনেও তেমন গুরুত্ব নেই।

রেমিট্যান্স বিষয়ে তার বক্তব্য, প্রতি বছর রেমিট্যান্স বাড়ছে ঠিকই। কিন্তু নতুন উত্স থেকে আসছে না। জি-টু-জি ভিত্তিতে শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি ব্যর্থ হয়েছে। আবার ব্যক্তিখাতের মাধ্যমে জনশক্তি রফতানি করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখা উচিত।

তিনি বলেন, বিদেশীদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি বরাদ্দের কথা বলা হচ্ছে। বিষয়টির সঙ্গে রাজনীতির একটি যোগসাজশ রয়েছে। উদ্যোগটি কতটা সফল হবে, তা দেখার বিষয়।

নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশের নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া নিয়ে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, অনেকে বলছেন, বাংলাদেশ যেভাবে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর হয়েছে, একই প্রক্রিয়ায় উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশেও উন্নীত হবে। কিন্তু বিষয়টি এত সহজ নয়। উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে দরকার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও দক্ষ মানবসম্পদ।

আইএলওর এমপ্লয়মেন্ট সেক্টরের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা ড. রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, বাজেটকে উন্নয়নকাজ বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হলেও একে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো বাস্তবায়নের বিষয়ে তেমন কোনো নির্দেশনা থাকে না। রফতানি বাড়ানোসহ অর্থনীতির আলোচনায় শুধু আর্থিক দিকগুলোই বেশি গুরুত্ব পায়। কিন্তু এর সঙ্গে রাজনীতিরও যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তা বিবেচনা করা প্রয়োজন। ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানের মতো দেশ ক্রমবর্ধমান রফতানি বাজার দখলে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে কেন পিছিয়ে পড়ছে, তা খতিয়ে দেখা উচিত।

তিনি আরো বলেন, এখানে একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়নি; তা হলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)। এসডিজি অর্জনের জন্য শুধু উচ্চপ্রবৃদ্ধি অর্জন করলেই হবে না। পূর্ণ কর্মসংস্থান, আয়বৈষম্য কমিয়ে আনা ও শিক্ষার মানোন্নয়নও প্রয়োজন হবে। কিন্তু এসব বিষয়ে বাজেটে তেমন কোনো নির্দেশনা দেখছি না। কয়েক বছর ধরে কৃষিতে প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী উল্লেখ করে তিনি কৃষির বহুমুখীকরণের ওপর জোর দেন।

বুয়েট শিক্ষক ড. ম. তামিম বলেন, বর্তমানের ৬ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ৮ শতাংশে উন্নীত হওয়ার জন্য সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার যে মান, তা দিয়ে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। কারণ নীতি ঠিক না থাকলে উন্নয়নকাজও ঠিকভাবে এগোবে না।

বিদেশী বিনিয়োগ প্রত্যাশার আগে দেশের অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে— এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, শিল্পায়ন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু জমির সমস্যা এক্ষেত্রে প্রকট। পাশাপাশি জ্বালানি ও বিদ্যুতের সমস্যা তো আছেই।

বিদ্যুত্ খাত নিয়ে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকার বিদ্যুত্ উত্পাদনে বড় বড় কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। কিন্তু দেশী অর্থায়নে এ ধরনের বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা এখনো বাংলাদেশের হয়নি। বিদেশী বিনিয়োগ ছাড়া এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আর ক্রমবর্ধমান বিদ্যুত্ বিতরণের জন্য যে ধরনের সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন দরকার, তা এখনো গড়ে ওঠেনি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র বাস্তবায়নে দেশীয় কয়লা উত্তোলন ও ব্যবহারের বিষয়ে নীতি প্রণয়নও জরুরি।

এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য প্রাক্কলন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ। তিনি বলেন, একটি সাধারণ অঙ্ক কষে সরকার বাজেট প্রণয়ন করে। প্রথমে একটি ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়। পরে সেখান থেকে জিডিপির ৫ শতাংশ ঘাটতি ধরে তা বিয়োগ করা হয়। এর পর বাকি যে অংশ থাকে, সেখান থেকে এনবিআর-বহির্ভূত কর ও কর ব্যতীত প্রাপ্তি বাদ দিয়ে বাকিটা এনবিআরের ওপর চাপানো হয়। সে কারণেই এবারের অর্থবছরে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আহরণের চাপ পড়বে এনবিআরের ওপর। ফলে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ কর্মীদের ওপর। আর লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ সম্ভব না হলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এডিপি বাস্তবায়নের ওপর। কারণ রাজস্বের লক্ষ্য ধরেই ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়। তাই আয় যদি ভালো না হয়, তাহলে ব্যয়ও সংকোচন হতে বাধ্য।

তিনি বলেন, ২০১৪-১৫ অর্থবছর শেষ হওয়ার পরদিনই এনবিআর চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলন করে জানালেন, রাজস্বে সংশোধিত লক্ষ্য অর্জন হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে হিসাব চূড়ান্ত হয় সেপ্টেম্বরে গিয়ে। আর লক্ষ্য পূরণের যে দাবি করা হচ্ছে, সেটা সম্ভব হয়েছে অগ্রিম আয়কর নেয়ার কারণে। ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের চিঠি দিয়ে অগ্রিম কর পরিশোধের জন্য চাপ দেয়া হয়েছে। এমনকি সময়মতো তা পরিশোধ করা না হলে অতিরিক্ত সুদ পরিশোধেরও বিধান রাখা হয়েছে। এমনটি করা হলে মানুষ কর প্রদানে নিরুত্সাহিত হবে।

এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন জিইডি সদস্য ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্য দেয়ার আগে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। এনবিআরের বর্তমান চেয়ারম্যান ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩২০ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিষয়ে কোনো আপত্তি করেননি। ফলে বড় লক্ষ্য হলেও তা অর্জনযোগ্য বলে মনে করছেন এনবিআর চেয়ারম্যান।

তিনি বলেন, ২০১০-১১ অর্থবছরে ২৭ শতাংশের মতো রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সুতরাং এবার ৩০ শতাংশের যে চ্যালেঞ্জ নেয়া হয়েছে, তা আহামরি কিছু নয়।

টাকার অভাবে উন্নয়ন কর্মসূচি কাটছাঁট করার তথ্যও সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন ড. শামসুল আলম। তার ভাষায়, অনেক ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয় করতে না পেরে ফেরত দেয়। অর্থাত্ এক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা রয়েছে। যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এডিপির গুণগত বাস্তবায়নের ওপর জোর দেয়া।

এফডিআই বিষয়ে তিনি বলেন, আগের বছরের তুলনায় ২০১৪ সালে এফডিআই কিছুটা কমেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই এটি কমেছে। তবে আগামী কয়েক বছরে এফডিআই বাড়বে। কারণ ভারত, চীন ও জাপান বিনিয়োগের জন্য এগিয়ে আসছে।

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২০ সালে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্তমানে সাড়ে ৬ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি আছে। এটিকে ৮ শতাংশে উন্নীত করতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানবসম্পদ উন্নয়ন। তাই সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ বিষয়ে জোর দেয়া হচ্ছে।

রফতানি বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেন ফিনএক্সেলের চেয়ারম্যান মামুন রশীদ। তিনি বলেন, বাজেটের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতের মধ্যে অন্যতম আমদানি-রফতানি। বিশেষ করে রফতানি না বাড়লে অর্থনীতি শক্তিশালী হবে না। এক্ষেত্রে একটি সুযোগ বাংলাদেশের সামনে আসছে। তা হলো বিশ্বের প্রধান তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ চীনের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। শিগগিরই এটি আরো নেমে যাবে বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণকারী সংস্থাগুলো বলছে। তাই পোশাক খাতকে আরো বেশি প্রণোদনা দিয়ে রফতানি সক্ষমতা বাড়াতে পারলে আন্তর্জাতিক বাজারে অবস্থান আরো শক্তিশালী হবে।

বিনিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা জমি অধিগ্রহণ। অনেকে বিনিয়োগে আগ্রহী হলেও জমি অধিগ্রহণে তিন-চার বছর সময় লেগে যায়। এতে বিনিয়োগ বিঘ্নিত হয়। এছাড়া জ্বালানি ও বিদ্যুতের নিশ্চয়তাও অপ্রতুল। এর মধ্যে ভারতের রিলায়েন্স ও আদানি বিনিয়োগে জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে এটি ইতিবাচক।

শেয়ারবাজারের বিষয়ে ড. মামুন রশীদ বলেন, বাজেটে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের করপোরেট কর কমানো হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের সুবিধা দিয়েও অনেক বড় প্রতিষ্ঠানকে শেয়ারবাজারে আনা যাচ্ছে না। এর অন্তর্নিহিত সমস্যা কী, তা খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি শেয়ারবাজার-সংক্রান্ত গবেষণা আরো শক্তিশালী করতে হবে। বাংলাদেশের বাজারের প্রকৃত অবস্থা বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের কাছে তুলে ধরে তাদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে হবে।

উন্নয়ন কার্যক্রমের ধীরগতির কারণে প্রকল্প ব্যয় অনেক বেড়ে যায় বলে উল্লখ করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক চার লেন প্রকল্পের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চার দফা খরচ বাড়িয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিনোহাইড্রো।

সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমেই বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে একটি শঙ্কাও আছে; তা হলো বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা। এ মন্দার কারণে আমাদের রফতানি সংকুচিত হতে পারে। তাছাড়া ডলারের বিপরীতে নিজেদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন হওয়ায় ভারত ও ভিয়েতনামের মতো দেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এতে তাদের রফতানি সক্ষমতা বেড়েছে। টাকার মান আরেকটু কমলে হয়তো আমাদের রফতানিকারকরা সুবিধা পেতেন।

যেসব দেশ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়, তার বড় একটি অংশ জ্বালানি তেল রফতানিকারক। অপরিশোধিত তেলের দাম কমে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় শ্রমিক রফতানি কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন তিনি। কারণ তেলের দাম কমলেও তাদের খরচ কমেনি।

বন্ডে বিনিয়োগ এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিকেন্দ্রীকৃত হয়ে অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির দেশে ধাবিত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারত আসিয়ানের সঙ্গে একটি এফটিএ করেছে; যার প্রভাব এরই মধ্যে আমাদের অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে। এমন চুক্তির ফলে বাংলাদেশ আগামীতে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, তা বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া আগামীতে ব্লু ইকোনমির উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, সরকারকে তার কৌশলগত দিকটি নির্ধারণ করতে হবে।

প্রতি বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার বাড়ছে। নতুন নতুন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না— এমন মন্তব্য করে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকারি বিনিয়োগ থেকে উপযুক্ত ফল পেতে হলে সুশাসন ও স্বচ্ছতার ওপর জোর দিতে হবে।

ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাখাওয়াত হোসেন বলেন, কোনো প্রকল্পের কাজ সময়মতো শেষ করার বিষয়ে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি গুণগত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে প্রকল্প বাস্তবায়ন খরচ বাড়তেই থাকবে।

ব্লু ইকোনমির বিষয়ে তিনি বলেন, বাজেট বক্তৃতায় এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সমুদ্রসম্পদ ব্যবহারের আগে প্রয়োজন এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সমুদ্রে বাংলাদেশের জলসীমা থেকে সম্পদ আহরণের আগে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ ও দক্ষ জনসম্পদ তৈরিতে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি কীভাবে সমুদ্রসম্পদ আহরণ করা হবে, সে অনুযায়ী বিনিয়োগ পরিকল্পনার বিষয়ে বাজেটে নির্দেশনা থাকা জরুরি।

ইংরেজি দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্ল্যানিং এডিটর আসজাদুল কিবরিয়া বলেন, এফডিআই বাড়ানোর বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে নীতিসহায়তা এখনো অপ্রতুল। বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে হলে বাইরের উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা দিতে হবে।

পোশাক রফতানির উেস করের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে এ খাতে উেস কর ছিল দশমিক ৮ শতাংশ। রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ অন্যান্য কারণে পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় গত অর্থবছর তা কমিয়ে দশমিক ৩ শতাংশ করা হয়। কিন্তু তা ছিল সাময়িক। সেই অর্থে পোশাক খাতের ভিত্তি উেস কর দশমিক ৮ শতাংশ। এ হিসাবে তাদের কর কমেছে, বাড়েনি। তাছাড়া খাতটি ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে সরকারের কাছ থেকে নগদ প্রণোদনাসহ নানা সুবিধা পাচ্ছে। একটি খাতের উন্নয়নে আর কত সময় প্রয়োজন? তাদের জন্য অন্যান্য খাত বঞ্চিত হচ্ছে।

উল্লেখ্য, মার্কেট পালসের ১০০তম সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করা হয় অনুষ্ঠানে।