Published in Amader Shomoy on Friday, 10 July 2015.
জিএসপি সুবিধা নিয়ে শঙ্কায় রপ্তানিকারকরা
উন্নয়নশীল দেশের পথে বাংলাদেশ
জাতিসংঘের বিবেচনায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হওয়ার শর্ত পূরণ করতে পারবে। আর উন্নয়নশীল দেশ হলেই সাধারণত আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা (জিএসপি) পাওয়া যায় না। এ বিষয়টিই ভাবিয়ে তুলেছে দেশের রপ্তানিকারকদের। তাদের মতে, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় গেলেও যেন জিএসপি বজায় থাকে সে ব্যাপারে সরকারকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সংকুচিত হয়ে পড়তে পারে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র।
এদিকে অর্থনীতি বিশ্লেষকরা জানান, উন্নয়নশীল দেশ হলেও অন্তত ২০২৭ সাল পর্যন্ত জিএসপি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। এছাড়া বিভিন্ন সূচকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যাওয়ার যোগ্যতা অর্জনের পরও সরকার চাইলে বাংলাদেশকে বর্তমানের মতো ‘স্বল্পোন্নত’ দেশের তালিকায় রেখে এ সুবিধা আরও দীর্ঘায়িত করতে পারবে।
জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন স্বল্পোন্নত দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) বিভিন্ন দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য রপ্তানি করে থাকে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে এমন সুবিধা দিয়ে থাকে। তবে কোনো দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে ওইসব সুবিধা হারায়। বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হলেও জাতিসংঘের শর্তানুযায়ী এখনো স্বল্পোন্নত দেশ। তিনটি শর্তের যে কোনো দুটি পূরণ করতে পারলেই জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে মর্যাদা দেবে। এর মধ্যে একটি ইতোমধ্যেই অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, দেশ মধ্যম আয়ের হলে তা হবে ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বড় সাফল্য। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসায়িক কাঠামোগত উন্নয়ন ঘটবে। তবে সেক্ষেত্রে আমরা হয়তো জিএসপি সুবিধা পাব না। তিনি আরও বলেন, মধ্যম আয়ের দেশ হলেও আমরা ইইউসহ অন্যান্য দেশে যেসব সুবিধা পাই, তা যেন অক্ষুণœ থাকে তা দেখতে হবে। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে কর্মপরিবেশ বাড়াতে হবে, যেন রপ্তানি বাড়ে। সঙ্গে কর্মসংস্থান তৈরিতে সরকারকে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে।
জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৯২৬ ডলার। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যে ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় আয়ের এ হিসাব করে থাকে জাতিসংঘ। ব্যক্তির গড় বার্ষিক আয় থেকে কর পরিশোধ ও অবনমন (ডিপ্রেশন কস্ট) বাদ দিয়ে বাকি অর্থ ব্যক্তি কেনাকাটা ও বিনিয়োগে ব্যয় করতে পারেÑ এভাবে এ সূচক নির্ণয় করে থাকে জাতিসংঘ। এ হিসাবে মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে ১ হাজার ২৪০ ডলার। জাতিসংঘের বাকি দুই সূচকের একটি হলো মানবসম্পদ সূচক (এইচএআই)। এ সূচকে ন্যূনতম ৬৬ বা তার বেশি অর্জন করতে হবে বাংলাদেশকে। মূলত জনগোষ্ঠীর পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নয়নকে মূল্যায়ন করেই এ সূচক নির্ণীত হয়। এসব ক্ষেত্রে যত অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হবে, বাংলাদেশের অবস্থানও তত বাড়বে। জাতিসংঘের সর্বশেষ হিসাবে বর্তমানে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৩ দশমিক ৮-এ। অর্থাৎ মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশকে আরও ২ দশমিক ২ ধাপ এগোতে হবে। ২০১৮ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ এ সূচক অতিক্রম করতে পারবে বলে মনে করছে সরকার। স্বল্পোন্নত দেশের অভিধা থেকে মুক্তি পেতে তৃতীয় শর্ত অর্থনৈতিক সংকট সূচক (ইভিআই)। কৃষি উৎপাদন, পণ্য ও সেবা রপ্তানি, প্রচলিত অর্থনৈতিক কর্মকা- ছাড়াও জিডিপিতে সম্পূর্ণ পণ্য উৎপাদন ও আধুনিক সেবার অংশীদারিত্ব ও ছোট অর্থনীতির প্রতিবন্ধকতা দূর করার ওপর এটি নির্ভর করে। এ ক্ষেত্র বেশ ভালোভাবেই উত্তরণ ঘটিয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের শর্ত অনুযায়ী, এক্ষেত্রে ৩২ বা তার চেয়েও কম অবস্থানে থাকতে হবে বাংলাদেশকে। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫ দশমিক ১-এ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রথম কথা হলো, জাতিসংঘ বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি দেবে না, তারা বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নেবে। এজন্য তিনটি সূচক আছে। তিনটি সূচকের দুটি সূচক ২০১৮ সাল নাগাদ অর্জন করতে পারলে বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় ঢুকতে পারবে। এরপর ৬ বছর পর্যবেক্ষণে থাকবে। ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়া যাবে। এর পরও তিন বছর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সুবিধা পাবে। সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ইইউ বা অন্য উন্নত রাষ্ট্রগুলো শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেয় না। তবে কোনো কোনো উন্নয়নশীল দেশকে এ সুবিধা দিয়েছে ইইউ। কয়েক বছর আগে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পাকিস্তানকে ইইউ জিএসপি সুবিধা দিয়েছে। পাশের দেশ শ্রীলংকাকেও এ সুবিধা দিয়েছে তারা। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পরও যেন বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পায়, সেজন্য এখনই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। সম্প্রতি ইইউর বিভিন্ন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এ বিষয়ে অনুরোধ জানালে তারা ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন।