Published in Kaler Kantho on Sunday, 26 July 2015.
২০১৮ সালেই জাতিসংঘের তিন শর্ত পূরণ করবে বাংলাদেশ
জিএসপিসহ এলডিসির সুবিধা থাকবে ২০২৭ পর্যন্ত
২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি
আবুল কাশেম
জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় জায়গা করে নিতে তিনটি শর্তের যেকোনো দুটি পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। এর মধ্যে একটি অর্জিত হয়েছে, বাকি দুটিও পূরণের কাছাকাছি। সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশা, ২০১৮ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ এলডিসির খেতাব মুছে ফেলার সব যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে। ওই সময়ের মধ্যেই জাতিসংঘের তিন সূচকেই সক্ষমতা অর্জনের ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০১৮ সালে উন্নয়নশীল দেশে পা রাখার শর্ত পূরণ করলেও লম্বা প্রক্রিয়া শেষে জাতিসংঘের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিলবে ২০২৪ সালে। আর এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জিএসপি, এইড ফর ট্রেডসহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যেসব সুবিধা ভোগ করছে, তা বহাল থাকবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত।
উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে জাতিসংঘের হিসাবে জাতীয় মাথাপিছু আয় (জিএনআই) এক হাজার ২৪০ ডলার, মানবসম্পদ সূচকে (এইচএআই) ৬৬ ও অর্থনৈতিক সংকট সূচকে (ইভিআই) ৩২ বা এর কাছাকাছি পয়েন্ট অর্জন করতে হয়। এর মধ্যে ইভিআই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫ দশমিক ১। অর্থাৎ এটি অর্জিত হয়েছে। আর জাতিসংঘের হিসাবে বাংলাদেশের বর্তমান জিএনআই ৯২৬ ডলার এবং মানবসম্পদ সূচকে অর্জন ৬৩ দশমিক ৮। দুটি সূচকের যেকোনো একটি ২০১৮ সালের মধ্যে অর্জন করতে পারলেই উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার শর্ত পূরণ হবে। তবে তাৎক্ষণিক আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাবে না বাংলাদেশ। ২০২১ সাল পর্যন্ত টেকসই অবস্থান ধরে রাখতে পারলে সাধারণ পরিষদের অনুমোদনের পর ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম তুলবে জাতিসংঘ।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) প্রতি তিন বছর পর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অগ্রগতির তথ্য পর্যালোচনা করে। গত মার্চে এ বৈঠক হয়েছে। সিডিপির পরবর্তী বৈঠক হবে ২০১৮ সালে। ওই সময়ের মধ্যে জাতিসংঘের তিনটি সূচকের যেকোনো দুটিতে সফলতা অর্জন করলে অথবা শুধু মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৪৮৪ ডলারে নিতে পারলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সুপারিশ পেতে পারে।
জাহিদ হোসেন বলেন, ২০১৮ সালের বৈঠকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলে পরবর্তী তিন বছর তা পর্যবেক্ষণে রাখবে সিডিপি। অর্থাৎ এ সময়ে দেশ এসব সূচকের ধারাবাহিকতা অর্জন করতে পারলে ২০২১ সালের বৈঠকে সিডিপি জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিলের (ইকোসক) কাছে সুপারিশ করবে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় ঠাঁই দিতে। এরপর ইকোসক তা অনুমোদনের জন্য পাঠাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। সেখানে অনুমোদিত হওয়ার পর সিডিপির ২০২৪ সালের বৈঠকে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা দেবে জাতিসংঘ।
জাহিদ হোসেনের মতে, জাতিসংঘের তিনটি সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, ২০১৮ সালের বৈঠকের আগেই বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে তিনটি সূচকই ছাড়িয়ে যাবে। ফলে ওই সময় সিডিপির সুপারিশ মিলবে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ২০২১ সালের বৈঠকে দ্বিতীয় সুপারিশ পাবে বাংলাদেশ, যার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিলবে ২০২৪ সালে। তবে ওই সময় আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার আগে জাতিসংঘ সরকারের কাছে এই মর্মে মতামত চাইবে যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি নেবে, নাকি স্বল্পোন্নত দেশের পরিচয়েই থাকবে। সরকার উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পক্ষে মতামত দিলে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দেবে।
বিশ্বব্যাংকের এই অর্থনীতিবিদ জানান, ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের জিএসপি, এইড ফর ট্রেডসহ অন্যান্য সুবিধা হাতছাড়া হবে না। বরং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করতে জাতিসংঘ ওই সব সুবিধা পরবর্তী তিন বছর বা ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবে।
উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পরও কোনো কোনো দেশ বিশেষ বিবেচনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। কয়েক বছর আগে বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার পর পাকিস্তানকে জিএসপি দিয়েছে ইউরোপ। সুনামির পর শ্রীলঙ্কাও এ সুবিধা পেয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর বাংলাদেশও যাতে এ সুবিধা পায়, সে জন্য এখন থেকেই চেষ্টা শুরু করেছে সরকার।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রথম কথা হলো, জাতিসংঘ বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি দেবে না, তারা বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নেবে। এ জন্য তিনটি সূচক আছে। এর দুটিই ২০১৮ সাল নাগাদ অর্জন করতে পারলে বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় ঢুকতে পারবে। এরপর ছয় বছর পর্যবেক্ষণে থাকবে। ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়া যাবে।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘২০১৮ সালে প্রাথমিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম লেখালেও জাতিসংঘ এটি আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে না। যেমন বিশ্বব্যাংকও স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারকে জানায়নি। কিন্তু তারা যে তালিকা করেছে, সেখান থেকে আমরা জানতে পেরেছি। জাতিসংঘের হিসাবে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার বিষয়টিও প্রাথমিক তালিকা দেখে বোঝা যাবে।’
তবে ২০২৪ সাল নাগাদ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি আসার আগেই সরকার ঘোষণা দিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। তবে সেটা ঠিক হবে কি না, তাও বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ এর সঙ্গে বিভিন্ন সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি জড়িত।
সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার রাজনৈতিক ঘোষণা দিয়েছে। এর আগেই বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে স্বীকৃতি অর্জনের বিষয়ে জানতে চাইলে ড. মোয়াজ্জেম বলেন, ‘সরকারের রাজনৈতিক স্লোগান ইতিমধ্যে অর্জিত হয়েছে। কারণ সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় স্থান দিয়েছে। তবে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়াটি বেশ কঠিন।’
সিটি গ্রুপের সাবেক কান্ট্রি অফিসার মামুন রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, স্থিতিশীল অর্থনীতি, রেমিট্যান্স প্রবাহ, কৃষি খাতের বিকাশ বিবেচনায় উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়া বাংলাদেশের জন্য আর কঠিন কিছু নয়। পাকিস্তান, নাইজেরিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশ উন্নয়নশীল খেতাব পেলে তা বাংলাদেশও পাবে। তবে এর জন্য বিপুল বিনিয়োগ ও কর্মযজ্ঞ সৃষ্টির বিষয়ে নজর দিতে হবে। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে মাথাপিছু আয় কমপক্ষে চার হাজার ১২৬ ডলার হতে হবে। জাতীয় আয় বাড়াতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, সামাজিক অবকাঠামো ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে।
মামুন রশিদ বলেন, দক্ষিণ সুদান নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার বদলে উল্টো নিচের ধাপে চলে গেছে। ব্রাজিল নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছেও আবার নিম্ন মধ্যম আয়ের কাতারে নেমে এসেছিল। নিম্ন মধ্যম আয় থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চীনের লেগেছে ১৭ বছর, দক্ষিণ কোরিয়ার ১৯ বছর এবং থাইল্যান্ডের ২৮ বছর।