সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও বেসিক ব্যাংক থেকে টাকা লুটের ঘটনার অর্থ হচ্ছে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ফাঁকফোকর রয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকার এসব কেলেঙ্কারি শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
Published in Amader Shomoy on Monday, 12 October 2015.
১১ হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির তথ্য চাইবে এপিজি
দেলোয়ার হুসেন ও হারুন-অর-রশিদ
বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তিনটি ঋণ জালিয়াতির ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইবে ঢাকা সফররত এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানিলন্ডারিং (এপিজি) প্রতিনিধি দল। ব্যাংকিং খাতে আলোচিত তিনটি বড় জালিয়াতির মধ্যে হলমার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা, বিসমিল্লাহ গ্রুপ চারটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং বেসিক ব্যাংক থেকে বিভিন্ন নামি বেনামি প্রতিষ্ঠান প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটিসহ ১১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। বাংলাদেশ মানিলন্ডারিং আইন প্রতিপালনে কম্পøায়েন্স দেশ হওয়ার পরেও কীভাবে এসব জালিয়াতির ঘটনা ঘটল সে সম্পর্কেই জানতে চাইবে এপিজি। প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবে। ওই বৈঠকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারাও উপস্থিত থাকবেন।
সূত্র জানায়, মানিলন্ডারিং আইন বাস্তবায়ন রয়েছে বিধায় দেশের কোনো ব্যাংকে বেনামে হিসাব খোলার সুযোগ নেই। একই সঙ্গে সুযোগ নেই অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো ঋণ দেওয়ার। তারপরও কীভাবে বেনামে ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাব খুলে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে সে সম্পর্কেই জানতে চাইবে এপিজি।
এদিকে বড় ধরনের ব্যাংকিং জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোর প্রতি বিদেশিদের আস্থা প্রশ্নের মুখে পড়ে। বিশেষ করে ঋণপত্র বা এলসির গ্রহণযোগ্যতাও কমে যায়। যদিও বর্তমানে পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়েছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকিং খাতের বড় অঙ্কের ঋণ জালিয়াতির ঘটনা নিয়ে এই প্রথম বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার মুখোমুখি হচ্ছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই ব্যাংক কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। এসব জালিয়াতির ঘটনা যেসব কর্মকর্তা তদন্ত করেছেন তাদেরও ওই বৈঠকে রাখা হচ্ছে।
তবে বৈঠকটির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গোপনীয়তা অবলম্বন করছে। জানা গেছে, মিশনের সফরের শেষ দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বেসিক ব্যাংক ও হলমার্ক কেলেঙ্কারি জাতীয়ভাবে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তবে আন্তর্জাতিকভাবে তেমন প্রভাব ফেলেছে বলে আমার মনে হয় না। যেহেতু বাংলাদেশের জন্য এটি বড় কেলেঙ্কারি বিষয়টি নিয়ে এপিজি বা অন্য কোনো সংস্থা জানতে চাইতে পারে।
বাংলাদেশে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রমে গৃহীত পদক্ষেপ মূল্যায়ন করতে গত শুক্র ও শনিবার ঢাকায় এসেছে এপিজির একটি প্রতিনিধি দল। ৮ সদস্যের ওই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এপিজি কো-চেয়ার অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক লেনন ক্লোজ।
মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী নীতি প্রণয়ন করে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ)। তাদের সহযোগী সংস্থা হিসাবে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মানিলন্ডারিং নীতিমালা বাস্তবায়ন তদারকি করে এপিজি। এর অংশ হিসেবেই তারা ঢাকায় এসেছে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আমাদের সময়কে বলেন, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও বেসিক ব্যাংক থেকে টাকা লুটের ঘটনার অর্থ হচ্ছে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ফাঁকফোকর রয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকার এসব কেলেঙ্কারি শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
যেসব ব্যাংকে এসব ঘটনা ঘটছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ওইসব ব্যাংকের ক্রেডিবিলিটি নষ্ট হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতারা যখন ঋণপত্র (এলসি) স্থাপন করবেন তখন নিশ্চয় ওই সব ব্যাংক এড়িয়ে চলবেন। যখন দেশের বড় ব্যাংকে এ ধরনের ঘটনা ঘটে তখন দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক লেনদেন করার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ে। সোনালী ও বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারির পর বিদেশি ক্রেতারা এ দুটি ব্যাংককে করেসপনডেন্ট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে এসব কেলেঙ্কারি বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তিনি বলেন, কেলেঙ্কারির মাধ্যমে লুট করা এসব টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু এগমন্ট, এপিজিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গ্রুপের সদস্য, আন্তর্জাতিকভাবেও চেষ্টা হচ্ছে মানিলন্ডারিং একেবারে না থাকুক। এ জন্য মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কে এসব গ্রুপ স্বাভাবিকভাবেই জানতে চাইবেন।
উল্লেখ্য, এসব বড় ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা নিয়ে এর আগে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চেয়েছিল।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে থেকে ওইসব ঘটনার শনাক্ত করার কৌশল এবং তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থা সম্পর্কে তুলে ধরা হবে। প্রতিটি ঘটনায়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদকে পাঠানো হয়েছে। দুদক হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এগুলো এখন বিচারাধীন। বেসিক ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনায় এর মূল নায়েক বেসিকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে বাদ দিয়ে ৫৬টি মামলা করেছে দুদক।
বড় ধরনের ব্যাংকিং জালিয়াতির প্রভাব সম্পর্কে অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, বড় ধরনের কেলেঙ্কারি জাতীয়ভাবে শুধু নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও আস্থাহীনতা তৈরি করে। কেননা বৈদেশিক লেনদেনে এসব ব্যাংকের অংশগ্রহণ রয়েছে। ব্যাংকের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং হচ্ছে কিনা স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক ক্রেতারা লেনদেন করার আগে খোঁজখবর নেবেন। কেলেঙ্কারির ঘটনা শুনলে নিশ্চয় আস্থার সংকট তৈরি হবে। তাই এসব কেলেঙ্কারি ঠেকানোর জন্য আইনের প্রয়োগ দরকার।