Published in Prothom Alo on Wednesday, 10 June 2015.
ভারতীয় গরু আসছে কম, প্রভাব বাজারে, চামড়াশিল্পে
কামরুল হাসান
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের করিডর দিয়ে গরু আসা গত পাঁচ মাসে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, এ রকম চলতে থাকলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ভারত সীমান্ত দিয়ে গরু আসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। তবে এর ফলে সীমান্তে গুলির ঘটনা ৯০ শতাংশ কমবে বলেও তাঁরা মনে করেন।
ঢাকার মাংস ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতীয় গরু আসা বন্ধ হওয়ার প্রভাব ইতিমধ্যে বাজারে পড়েছে। প্রতিটি খুচরা ও পাইকারি বাজারে গরুর দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। আর গরুর মাংসের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৮০ টাকা। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিকল্প দেশ হিসেবে নেপাল, ভুটান বা মিয়ানমার থেকে গরু আনার প্রস্তাব করেছেন ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গরু আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে যাবে। বন্ধ হয়ে যাবে সীমান্তের আশপাশে গড়ে ওঠা গরুর হাটগুলো। সীমান্তে বসবাস করা বেকার হওয়া মানুষ ফেনসিডিল বা ইয়াবার মতো মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়বে। গরু আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়বে চামড়াশিল্পেও। দেশের চামড়া কারখানাগুলোর উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসবে। এর সঙ্গে আমিষের ঘাটতি তো আছেই।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বিজিবির হিসাব অনুসারে, প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখ গরু ভারত থেকে আনা হয়। এ খাতে লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। সরকারি হিসাবে, ২০১৪ সালে গরু এসেছে ২০ লাখ ৩২ হাজার। ২০১৩ সালে আসে ২৩ লাখ ৭৪ হাজার, অর্থাৎ মাসে প্রায় ২ লাখ করে গরু এসেছে। কিন্তু এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকে গরু আসা কমতে থাকে। যেখানে গত জানুয়ারিতে গরু আসে ১ লাখ, সেখানে ফেব্রুয়ারিতে আমদানি হয় মাত্র ৪৮ হাজার ৪৫০টি, মার্চে আসে ৪৪ হাজার ৯৪৫টি। মে মাসের হিসাবটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মে মাসে ২০ হাজারের বেশি গরু আসেনি।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি ভারতের ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, ২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং গরু পাচার বন্ধ করার জন্য বিএসএফের প্রধান আশিস মিত্রকে নির্দেশ দেন। এরপরই গরু নিয়ে সীমান্তে কড়াকড়ি শুরু হয়।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সহকারী গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গরু-বাণিজ্য নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গরুর বাজার উন্মুক্ত করার জন্য ভারতের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। তবে দিনে দিনে সেই আলোচনা জটিল হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং কীভাবে চাহিদা পূরণ হবে, তা নিয়ে বাংলাদেশের বিকল্প কিছু করার সময় এসেছে। বাংলাদেশ মাংস আমদানি করবে না, অন্য কোনো উপায়ে চাহিদা পূরণ করবে, তা ভাবতে হবে।
বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এখন যে অবস্থা চলছে, তাতে ভারত থেকে গরু আসা খুব অল্প দিনের মধ্যে হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। তাই গরুর জন্য অন্য দেশের ওপর ভরসা না করে কী করে নিজেদের দেশে গরুর উৎপাদন বাড়িয়ে মাংসের অভাব পূরণ করা যায়, সেদিকে জোর দিতে হবে।
বিজিবির কর্মকর্তারা বলছেন, গরু আনা-নেওয়া বন্ধ হয়ে গেলে সীমান্তে গুলির ঘটনাও কমে যাবে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে যেসব গুলির ঘটনা ঘটে, তার ৯০ শতাংশ ঘটনার পেছনেই থাকে গরু-বাণিজ্য। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সীমান্তে গুলিবর্ষণের ঘটনায় ২৮৮ জন নিহত হয়েছেন। ২০১৪ সালে মারা যান ৪০ জন। আর এ বছরের মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে মারা গেছেন ১৮ জন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও পশুসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৫০ লাখ গরু জবাই হয়। এর প্রায় অর্ধেকই আসে ভারত থেকে। কিন্তু ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতির কথা বিবেচনা করে কখনো গরু রপ্তানির অনুমতি দেয়নি ভারত। এ অবস্থায় গো-মাংসের বাজার স্থিতিশীল রাখতে দেড় দশক আগে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে করিডর-ব্যবস্থা চালু করে সরকার। এ ব্যবস্থায় প্রথমে সীমান্তের ওপার থেকে আসা গরু একটি খোঁয়াড়ের মতো স্থানে জড়ো করা হয়। এরপর শুল্ক কর্মকর্তারা মালিকানাবিহীন দেখিয়ে গরুগুলোকে ‘বাজেয়াপ্ত’ ঘোষণা করেন। এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে বাজেয়াপ্ত করার জন্য কাগজে-কলমে সংক্ষিপ্ত বিচার দেখানো হয়। এরপর ‘রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাজেয়াপ্ত’ গরু মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে গরু ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
বাস্তবে গরু চোরাকারবারিদের কাছ থেকেই গরু ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত টাকার বিনিময়ে গরু কেনেন। আর সরকারকে ৫০০ টাকা দিয়ে গরুর মালিকানা বাবদ চার দিন মেয়াদি একটি বৈধ রসিদ নেওয়া হয়। বৈধভাবে এটাই হলো গরু আনার বাংলাদেশি ব্যবস্থা। তবে ভারতের কাছে এ ব্যবস্থার কোনো স্বীকৃতি নেই। ভারত থেকে এভাবে গরু আনতে সীমান্তের রাজশাহী অঞ্চলে ১২টি, যশোরে ৯, খুলনায় ৪, সিলেট ও চট্টগ্রামে ৩টি করে মোট ৩১টি করিডর স্থাপন করা হয়েছে।
যশোরের ২৩ বিবিজির অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, যশোর সীমান্তের পুটখালী, রুদ্রপুর ও অগ্রঘুলট করিডর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার গরু আসত। এখন আসছে না বললেই চলে। তিনি বলেন, এত দিন সীমান্তের হাজার হাজার মানুষ এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন তা বন্ধ হয়ে গেলে এর সঙ্গে জড়িত লোকজন চোরাচালানে জড়িয়ে পড়বে। এতে করে ফেনসিডিলের মতো মাদকদ্রব্যের চোরাচালান বেড়ে যাবে। সীমান্ত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও এ জন্য খারাপ হতে পারে।
সাতক্ষীরার সাতানি, কুলিয়া ও বসন্তপুর এবং নওগাঁর সাপাহার সীমান্তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই সব সীমান্তেও গরু আসা ব্যাপক কমে গেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমানগর সীমান্তের ব্যবসায়ী আবদুস ছালাম গত শনিবার প্রথম আলোকে জানান, গত সাত দিনে ওই সীমান্ত দিয়ে একটি গরুও আসেনি।
বাংলাদেশের গরুর মাংস রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল মিটের করপোরেট বিক্রয়প্রধান সৈয়দ হাসান হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হলে তাঁদের রপ্তানিতে সমস্যা দেখা দেবে। ইতিমধ্যে মাংসের দাম বেড়ে গেছে। চাষিরা যদি আজ থেকে গরু লালন-পালন শুরু করেন, তারপরও ২০ লাখ গরুর ঘাটতি মেটাতে তিন বছর লেগে যাবে।
ভারতীয় গরু আসা বন্ধ হয়ে গেলে তার প্রভাব পড়বে চামড়া ও চামড়াজাতশিল্পে। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ভারত থেকে বছরে ২০ লাখ গরু আসে। এটা না এলে চামড়া কারখানাগুলো ২০ লাখ চামড়া কম পাবে। এতে করে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে যাবে। চামড়াশিল্পে এর প্রভাব এখনই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
রাজধানীর বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জানুয়ারি মাসে প্রতি কেজি গরুর মাংস ছিল ৩২০ টাকা। পাঁচ মাসে স্থানভেদে কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। ভারতীয় গরু না আসার অজুহাত দেখিয়ে মাংসের দাম বাড়িয়ে চলেছেন বিক্রেতারা। ক্রেতাদের অভিযোগ, সরকারের সঠিক তদারকি না থাকার কারণে বিক্রেতারা ইচ্ছেমতো দাম নিচ্ছেন।
ক্রেতাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপাতত এর কোনো সহজ সমাধান দেখতে পাচ্ছি না। নিজস্ব ব্যবস্থায় সরবরাহ না বাড়ানো পর্যন্ত স্বল্প মেয়াদে ক্রেতাদের পকেট থেকে টাকা যাবে বলেই মনে হচ্ছে।’
বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম স্বীকার করেন, রাজধানীর অনেক বাজারে গরুর মাংস ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিনি জানান, গত তিন মাসে দেশের নিজস্ব গরু বাজারে মাংসের চাহিদা মিটিয়েছে। এখন তা শেষের দিকে।