Published in The Daily Inquilab on Tuesday, 29 April 2014
ইউয়ানের ব্যাপক অবমূল্যায়ন
পোশাক শিল্পে নতুন খড়গ
তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে ডলারের বিপরীতে চীনা মুদ্রা ইউয়ানের ক্রমহ্রাসমান মূল্যমান। গত দশদিন ধরে চীন ডলারের বিপরীতে তার মুদ্রারমান ব্যাপকহারে কমিয়েছে। ২০১২ সালের পর গত ২৭ এপ্রিল ইউয়ানের মান ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে কম। চলতি বছরে ইউয়ানের মান কমেছে ৩ দশমিক ২ শতাংশের বেশি। এদিকে গত প্রায় এক বছর ধরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান একই রয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য হুমকিতে পড়েছে। রপ্তানিকারকরা ডলারের বিপরীতে টাকার বিশেষ অবমূল্যায়িত মান বেধে দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন গত এক বছর ধরে। তবে এ বিষয়ে কোন কর্ণপাত করেনি সরকার। এ বিষয়ে এখনই সজাগ না হলে রপ্তানি বাণিজ্যে অপূরণীয় ক্ষতির আশঙ্কা ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকদের।
ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনা মুদ্রার মান কমিয়ে ফেলায় আন্তর্জাতিক বাজারে এবং চীনে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। চীনা মুদ্রার মান কমে যাওয়া এবং বাংলাদেশের মুদ্রারমান শক্তিশালী অবস্থানে থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে চীনা উৎপাদক ও রপ্তানিকারকরা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। এতে বিশেষ করে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ। কারণ চীন তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী। পাশাপাশি চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি কমে যাবে। এতে চীনের সাথে থাকা বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির অঙ্ক আরও বড় হবে। তবে চীন থেকে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ সুবিধা পাবে বলে মত দিয়েছেন গবেষকরা।
এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও সাবেক বিজিএমইএ সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, চীন আমাদের বড় প্রতিযোগি। আমরা যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজারে একই ব্যবসা (গার্মেন্ট) করি, তাই চীনের মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে তার প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বেড়ে গেছে। এছাড়া চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারেও আমরা পিছিয়ে পড়বো। চীনের বাজারে আমাদের যে একটি বড় সুযোগ তৈরি হয়েছিল তা হারাতে হবে। চায়নাতে আমরা গত বছর ১শ’ মিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি করেছি। সামনের দিনে এই রপ্তানি কমে যাওয়ার শঙ্কা প্রাকাশ করেন তিনি। কারণ বাংলাদেশের মুদ্রা মান শক্তিশালী অবস্থানে আছে। বিপরীতে চীনের মুদ্রার মান দিন দিন কমে যাচ্ছে। এতে চীনের আমদানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এতে বাংলাদেশ রপ্তানির একটি বড় সুযোগ হারাবে।
মুর্শেদী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চীনা ব্যবসায়ীদের সুযোগ বাড়বে। কারণ মুদ্রার মান কমায় তাদের সক্ষমতা বাড়ছে। আর আমাদের মুদ্রা অনেক ‘শক্তিশালী’ হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে একই হার অব্যাহত রয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে টাকা আরও শক্তিশালী হতে শুরু করেছে। এতে আমাদের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
আমাদের প্রতিযোগি দেশগুলোর মুদ্রার মান কমে গেলেও টাকার অবমূল্যায়ন না করায় বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। মি. মুর্শেদী জানান, শীতকালীন অর্ডার ইতোমধ্যে কমে গেছে। গত মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। সামনের দিনে রপ্তানি আরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তিনি এই সংকট সমাধানে সরকারের কাছে দুটি দাবি জানান। প্রথমত, রপ্তানিকারকদের জন্য টাকা-ডলারের একটি বিশেষ অবমূল্যায়িত বিনিময় হার বেধে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ছোট, বড় সকল রপ্তানিকারকদের জন্য রেট একই হবে। একই সঙ্গে গার্মেন্ট খাতের জন্য আগামি বাজেটে পলিসি সাপোর্টের আবেদন জানিয়েছেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, চীনের মুদ্রার অবমূল্যয়ন হওয়াতে এবং আমাদের মুদ্রামান অপরিবর্তিত থাকায় চায়নার সুবিধা হবে, আমাদের অসুবিধা হবে। চীনে আমাদের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে চীন বাড়তি সুবিধা পাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, আমরা প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাচ্ছি। আমরা ভারতের কাছে যেভাবে মার খেয়েছি, চীনের কাছেও সেভাবে মার খেতে হবে। কারণ চীনের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বেড়ে গেছে। ভারতে রুপির অবমূল্যায়নের কারণে ওদের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ১৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আর আমাদের প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশ কমেছে। এতে আমাদের প্রধান প্রতিযোগি হিসেবে ভারত ২৭ শতাংশ বাড়তি সুবিধা পেয়েছে। চীনের কাছে যাতে আমরা মার না খাই সেজন্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ডলারের বিপরীতে টাকার বিশেষ অবমূল্যায়িত বিনিময় হার বেধে দিতে হবে। এজন্য গত এক বছর ধরেই সরকারের কাছে আমরা আবেদন জানিয়ে আসছি। তবে সরকার এটা বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বিশেষ অবমূল্যায়িত হার বাস্তবায়ন না হলে বিশ্বব্যাপী আমরা দর-কষাকষির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবো বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, চীনের মুদ্রা অবমূল্যায়ন করলে চীনা রপ্তানিকারকদের সুবিধা হবে। চীন যেহেতু বিপুল পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে তাই সে আন্তর্জাতিক নীতিমালার আলোকেই তার রপ্তানির স্বার্থে মুদ্রা অবমূল্যয়ন করে থাকে। এটা সে ধারাবাহিকভাবেই করে আসছে। বাংলাদেশ তার আমদানির একটি বিরাট অংশ চীন থেকেই করে। বিশেষ করে গার্মেন্ট খাতের কাঁচামাল ও মেশিনারিজ বেশিরভাগই চায়না থেকে আমদানি করা হয়। তাই এই দিক দিয়ে তৈরি পোশাক খাতের জন্য এটা বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে। তবে বাংলাদেশ চীনে রপ্তানির ক্ষেত্রে অনেক প্রতিযোগিতা বাড়বে। কারণ চীনারা তখন লোকাল মার্কেট থেকে পণ্য সংগ্রতে আগ্রহী হবে। বাংলাদেশ চীনে খুব বেশি পণ্য রপ্তানি করে না। তাই আমাদের সুবিধা। বাংলাদেশের জন্য বাণিজ্য সহায়ক। তবে মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীন বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে। এটা বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের অসুবিধায় ফেলছে।